অলসতা উদ্যমহীনতা ও উদাসীনতা এমন রোগ যা মানুষকে দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্য থেকে পিছিয়ে দেয়। কিছু বিষয় আছে যার ফলাফল তাৎক্ষণিক পাওয়া যায় না। ভবিষ্যতে মেলে। পদে পদে আসে, পালাবদল করে আসে। অলসতা, বেখেয়ালিপনা, গাফলতি—এর অনেক নাম থাকলেও এটি এমন এক রোগ, যার খারাপ পরিণতি থেকে কেউ রেহাই পায় না। আমরা অলসতা অনুভব করি ঘুম থেকে উঠতে, অলসতা অনুভব করি কাজে-কর্মে, এমনকি নিশ্চিত সাফল্যের পথে অগ্রসর হতেও অলসতা অনুভব করি। আমাদের মনোবলকে প্রায়ই বাগে নিয়ে ফেলে অলসতা নামক এই কালপিট। ‘পরে করব’ গোলকধাঁধায় ফেলে রাখে দীর্ঘকাল। ফলশ্রুতিতে ভবিষ্যৎ হয় হতাশা এবং আফসোসের।

এক. প্রথমেই উক্ত রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। আপনি বলবেন, আমি যা চাই, তাই করতে পারব। আপনাকে কষ্ট ও মেহনত করার জন্য হিম্মত করতে হবে, এই রোগ থেকে উত্তরণের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।

দুই. দীর্ঘ আশা ইবাদতে অলসতা তৈরি ও তাওবার ক্ষেত্রে গড়িমসি তৈরি করে। আপনি হয়ত জীবন সম্পর্কে অতিরিক্ত আশা করে বসে আছেন যে, হায়াত অনেক পাবেন আর শেষ জীবনে তাওবা করে নিবেন! ব্যাস, হয়ে যাবে! এটা মূলত আশা নয়, বরং ধোঁকা। সুতরাং এজাতীয় ‘অন্যায়-আশা’, যা আপনাকে আমল ও তাওবা থেকে বিমুখ করে দিচ্ছে, তা এখনই বর্জন করুন। রাসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বলেছেন,

সাতটি বিষয়ের পূর্বে তোমরা দ্রুত নেক আমল করো। তোমরা কি এমন দারিদ্র্যের অপেক্ষা করছ, যা তোমাদেরকে সবকিছু ভুলিয়ে দেবে? না ওই ঐশ্বর্যের, যা তোমাদেরকে দর্পিত বানিয়ে ছাড়বে? নাকি এমন রোগের, যার আঘাতে তোমরা জরাজীর্ণ হয়ে পড়বে? না সেই বার্ধক্যের, যা তোমাদেরকে অথর্ব করে ছাড়বে? নাকি মৃত্যুর, যা আকস্মিক এসে পড়বে? নাকি দাজ্জালের, অনুপস্থিত যা কিছুর জন্যে অপেক্ষা করা হচ্ছে, সে হচ্ছে সেসবের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট? না কিয়ামতের অপেক্ষা করছ, যে কিয়ামত কিনা সর্বাপেক্ষা বিভীষিকাময় ও সর্বাপেক্ষা তিক্ত? (তিরমিযি ২৩০৬ যুহদ অধ্যায়)

তিন. নেক আমল কিংবা তাওবা করার চিন্তা মনে আসার সঙ্গে সঙ্গে তা করে ফেলুন। আজকের নেক আমল এবং আজকের তাওবা আজকেই করতে হবে। আগামীকালের অপেক্ষায় রেখে দেয়া যাবে না কিছুতেই। আল্লাহ তাআলা বলেন,

তোমরা তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং এমন জান্নাতের দিকে দ্রুত ধাবিত হও, যার প্রশস্ততা হবে আকাশসমূহ ও জমিনসম। তা মুত্তাকিদের জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। (সূরা আলে ইমরান ১৩৩)

চার. অনেক ক্ষেত্রে অলসতার অন্যতম কারণ থাকে উৎসাহ উদ্দীপনার অভাব। নিজেকে জাগাতে আপনি আল্লাহওয়ালাদের জীবনী, তাঁদের সফলতার গল্প, তাঁদের বাণী পড়ুন, জানুন । অলসতা দূর করতে খুব বেশি কাজে লাগবে এগুলো।

পাঁচ. যাঁরা আপনার চাইতে বেশি উদ্যমী এবং আমলে অগ্রসর তাঁদেরকে দেখুন। বিশেষত আল্লাহওয়ালাদের চেহারা দেখুন, তাঁদের মজলিসে বসুন, তাঁদের কথা শুনুন এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা সঞ্চয় করুন।  আল্লাহ তাআলা বলেন,

হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক। (সূরা তাওবা ১১৯)

ছয়. যখন অলসতা ভর করে ঠিক তখন নিজেই নিজেকে অনুপ্রাণিত করুন। এটা আপনাকে আমল করতে উদ্বুদ্ধ করবে। এভাবে ভাবুন যে, অলসতা, উদ্যমহীনতা ও উদাসীনতা এগুলো তো শয়তানের সৃষ্ট, ব্যর্থ মানুষের স্বভাব। সুতরাং আমি কেন শয়তানের শিকারে পরিণত হয়ে ব্যর্থদের কাতারে শামিল হব। তারপর তাআউয (আউযুবিল্লাহ…) ও ইস্তেগফার পড়ে আমলের প্রতি ব্রতী হোন। রাসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বলেছেন,

আল্লাহর কাছে শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিন থেকে অধিক উত্তম ও প্রিয়। তুমি ঐ জিনিসে যত্নবান হও, যাতে তোমার উপকার আছে এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর ও উৎসাহহীন হয়ো না।(মুসলিম ৪৮২২)

সাত. বর্তমানে আমাদের অবসর সময়গুলোর সঙ্গী হয়ে থাকে সোশ্যাল মিডিয়া, স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ বা টেলিভিশন। এসবের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিজেকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে। বিশেষত এগুলো যেন আপনার রাতের ঘুম কেড়ে নিতে না পারে, সে দিকে বিশেষ খেয়াল রাখুন। দেখবেন, আমলে মন বসবে এবং অলসতাও হার মানবে। রাসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বলেছেন,

একজন ব্যক্তির ইসলামের পরিপূর্ণতার একটি লক্ষণ হল যে, তার জন্য জরুরী নয় এমন কাজ সে ত্যাগ করে। (তিরমিযী ২২৩৯)

আট. যত কষ্টই হোক, ফজরের নামাযের প্রতি যত্নবান হোন। কেননা অলসতার কারণে ফজরের নামায না পড়তে পারলে এটাই হবে সারাদিনের আমলহীনতা, গুনাহমুখিতা ও অন্যান্য অলসতার সূচনা। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বলেন,

যখন তোমাদের কেউ নিদ্রা যায় তখন তার গ্রীবাদেশে শয়তান তিনটি করে গাঁট বেঁধে দেয়; প্রত্যেক গাঁটে সে এই বলে মন্ত্র পড়ে যে, ‘তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত, অতএব তুমি ঘুমাও।’ অতঃপর যদি সে জেগে উঠে আল্লাহর যিকির করে, তাহলে একটি গাঁট খুলে যায়। তারপর যদি ওযু করে, তবে তার আর একটি গাঁট খুলে যায়। তারপর যদি নামায পড়ে, তাহলে সমস্ত গাঁট খুলে যায়। আর তার প্রভাত হয় স্ফূর্তি ও ভালো মনে। নচেৎ সে সকালে ওঠে কলুষিত মনে ও অলসতা নিয়ে। (বুখারী ১১৪২)

নয়. ফজরের পরে ঘুম বর্জন করুন। কেননা এটাও অলসতা ও উদ্যমহীনতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ। সুতরাং এই সময়ে না ঘুমিয়ে নামায আদায় করে তাসবীহ-তাহলীল, যিকর-আযকার ও তেলাওয়াত শুরু করে দিন। এমনটি করতে পারলে রাসূলুল্লাহ্‌ এর দোয়া পাবেন এবং আপনার সারদিনের কাজে অলসতা কেটে যাবে। রাসূলুল্লাহ্‌ -এর দোয়াটি দেখুন, তিনি বলেন,

হে আল্লাহ, আমার উম্মতের জন্য দিনের শুরু বরকতময় করুন। (তিরমিযি ১২১২)

দশ. অলসতা, উদ্যমহীনতা ও উদাসীনতা থেকে মুক্তির জন্য হাদিসে যে সব দোয়া শিক্ষা দেয়া হয়েছে, সেগুলো পড়ুন। যেমন,

হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি আপনার আশ্রয় নিচ্ছি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে, অপারগতা ও অলসতা থেকে, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে, ঋণের ভার ও মানুষদের দমন-পীড়ন থেকে। (বুখারী ২৮৯৩)

হে আল্লাহ! আমি আপনার আশ্রয় নিচ্ছি অক্ষমতা, অলসতা, কাপুরুষতা, কৃপণতা, বার্ধক্য ও কবরের আযাব থেকে। হে আল্লাহ! আপনি আমার মনে তাকওয়ার অনুভূতি দান করুন, আমার মনকে পবিত্র করুন।  আপনিই তো আত্মার পবিত্রতা দানকারী। আপনিই তো হৃদয়ের মালিক, অভিভাবক ও বন্ধু। হে আল্লাহ! আপনার নিকট আশ্রয় চাই এমন ইলম থেকে যে ইলম কোনো উপকার দেয় না, এমন হৃদয় থেকে যে হৃদয় বিনম্র হয় না, এমন আত্মা থেকে যে আত্মা পরিতৃপ্ত হয় না এবং এমন দোয়া থেকে যে দোয়া কবূল হয় না। (মুসলিম ২৭২২)

এগারো. কম খান, কর্মোদ্যম থাকুন
অতি ভক্ষণ অলসতার দিকে ধাবিত করে, ঘুম ঘুম ভাব এনে দেয়। তাই নবীজি (ﷺ)-এর এই উপদেশটি আমাদের সবার মেনে চলা উচিত:

‘পেটের চেয়ে মন্দ কোনো পাত্র মানুষ ভরাট করে না। পিঠ সোজা রাখার মত কয়েক লোকমা খাবারই আদম সন্তানের জন্য যথেষ্ট। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে পেটের এক তৃতীয়াংশ খাবার, এক তৃতীয়াংশ পানি, আরেক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে।’ [তিরমিযী (২৩৮০)]

বারো. অলসতার আলামত: হাই তোলা
নবীজি (ﷺ) বলেন,

‘হাই তোলা শয়তানের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। সুতরাং তোমাদের কারো যখন হাই আসবে তখন যথাসম্ভব দমন করবে। কেননা তোমাদের কেউ হাই তোলার সময় যখন ‘হা’ বলে, তখন শয়তান হাসতে থাকে।’ [বুখারী (১৯৯৩)]

তেরো. প্রোডাক্টিভ মানুষদের সাথে চলুন
মানুষ তার মতই হয়, যার সাথে তার অধিকাংশ সময় কাটে। আপনি যদি অলস ব্যক্তিদের সাথে সময় কাটান, তাহলে এমনটা আশা করা যায় না আপনার অলসতা দূর হয়ে যাবে। এ জন্য আপনাকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। যাদের দেখে নিজের উন্নতি করা যায়, এমন মানুষদের খুঁজে বের করুন, তাদের সাথে সময় দিন। নবীজির এই হাদীসটি আমরা সকলেই জানি,

‘ব্যক্তি তার বন্ধুর দ্বীনের ওপরেই থাকে। সুতরাং তার অবশ্যই চিন্তা করা উচিত, কাকে বন্ধু বানাচ্ছে।’ [তিরমিযী, (২৩৭৮)]

চৌদ্দ. অজুহাত দেবেন না। আল্লাহ বলেন,

‘বরং মানুষ নিজের সম্পর্কে সম্যক অবগত। যদিও সে নানা অজুহাতের অবতারণা করে।’ [সূরা কিয়ামাহ, ৭৫: ১৪-১৫]

অজুহাত দিয়ে অন্যের আদালত থেকে নিস্তার পাওয়া গেলেও নিজের আদালত থেকে মুক্তি মিলবে না। বরং অলসতার অজুহাত ব্যক্তিকের জন্যই কাল হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই অজুহাত দিবেন না ফরজ সালাতের ক্ষেত্রে, কারণ, আপনি জানেন এ জন্য আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে। অজুহাত দেবেন না তাওবাহ করতে, কারণ, পাপের শাস্তি আপনাকেই ভোগ করতে হবে। অজুহাত দেবেন না নিজের ভুল স্বীকারে, কারণ, মনের তিল পরিমাণ অহংকারই যথেষ্ট ব্যক্তিকে জাহান্নামে প্রবেশ করাতে।

সংগৃীত

Views: 3