মহান আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য নেয়ামতের মধ্যে জবান অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। সঠিক কাজে জবান ব্যবহার করা, অন্যায়, অসত্য ও হারাম থেকে জবানকে বিরত রাখা আল্লাহর দিদার লাভের সহজ উপায়। এক কথায় জবানের হেফাজত করা মুমিন জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
পবিত্র কুরআনের সুরা মুমিনুনের শুরুতে আল্লাহ তায়ালা খাঁটি মুমিনদের সাতটি গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। এরমধ্যে দ্বিতীয় গুণ হচ্ছে, যারা অনর্থক কথাবার্তায় নির্লিপ্ত। আল্লাহ ইরশাদ করেন,
হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বলো। তাহলে আল্লাহ তোমাদের কার্যক্রমসমূহ সংশোধন করবেন এবং তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। (সুরা আহজাব : ৭০-৭১)
ইসলামের দৃষ্টিতে জবানের হেফাজত : কিছু মানবিক উত্তম গুণের সমন্বিত একটি রূপকে ইসলামের দৃষ্টিতে জবানের হেফাজত বা বাক সংযম বলা হয়।
১. কথা বলায় সাবধানতা : হজরত বিলাল বিন হারিস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির এমন ও কথা বলে যার কল্যাণের কথা সে ধারণাই করতে পারে না অথচ তার দরুন কিয়ামত অবধি তার সন্তুষ্টি লিপিবদ্ধ করে দেন । আবার মানুষ আল্লাহর অসুন্তুষ্টির এমন ও কথা বলে যার অকল্যাণের কথা সে ধারণাই করতে পারে না অথচ তার দরুণ কিয়ামত অবধি তার অসন্তুষ্টি লিপিবদ্ধ করে দেন। (তিরমিজি, মুয়াত্তা মালেক)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে। (বুখারি ও মুসলিম)।
অন্য হাদিসে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন,
কোনো বান্দা ভালো-মন্দ বিচার না করে এমন কোনো কথা বলে ফেলে, যার কারণে সে পদস্খলিত হয়ে জাহান্নামের এতদূর গভীরে চলে যায়, যা পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের দূরত্বের সমান। (বুখারি)
২. মিষ্টভাষী হওয়া : হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
নিশ্চয় জান্নাতে বালাখানা থাকবে, যার ভেতরের সব কিছু বাইরে থেকে দেখা যাবে। একজন বেদুঈন দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ওই বালাখানা কাদের জন্য হবে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, যারা মিষ্টবাষী হবে, অভাবীদের আহার করাবে, রাতের গভীরে নামাজ পড়ে। (তিরমিজি)
৩. নাজাতের পথ বাকসংযম : হজরত উকবা ইব্ন আমের (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! নাজাত পাওয়ার উপায় কি? তিনি জবাব দিলেন, তোমার কথাবার্তা সংযত রাখ, তোমার ঘরকে প্রশস্ত কর (মেহমানদারী করা) এবং তোমার কৃত অপরাধের জন্য আল্লাহর নিকট কান্নাকাটি কর। (তিরমিজি)। হজরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
সকালে মানুষ যখন ঘুম থেকে উঠে, তখন তার দেহের সকল অঙ্গ-প্রতঙ্গ যিহবাকে অনুনয়-বিনয় করে বলে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। কেননা, আমরা তোমার সাথে সম্পৃক্ত। তুমি যদি সঠিক পথে থাক, আমরাও সঠিক পথে থাকতে পারি। আর তুমি যদি বাঁকা পথে চল, তাহলে আমরাও বাঁকা পথে যেতে বাধ্য। (তিরমিজি)
৪. সর্বোত্তম মুসলিম : এ বিষয়ে হজরত আব্দুল্লাহ ইব্ন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ থেকে মুসলমানরা নিরাপদ থাকে। (বুখারি)
৫. জান্নাতের জিম্মাাদারী : জবানের হেফাজত এত বড় আমল যার বিনিময় স্বরূপ রাসুলুল্লাহ (সা.) জান্নাতের জিম্মাদার হয়ে যান, হজরত সাহল ইবনে সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
যে ব্যক্তি তার দু’চোয়ালের মধ্যবর্তী বস্তু , অর্থাৎ জিহ্বা এবং তার দুই উরুর মধ্যবর্তী তথা লজ্জাস্থানের জিম্মাদার হবে আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হবো। (বুখারি)।
জবানের হেফাজত না করার কারণে জাহান্নাম ঠিকানা হতে পারে, যেমনিভাবে হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হজরত মুয়াজ ইব্ন জাবাল (রা:) একবার বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমরা যা বলি তা নিয়ে কি আমাদের পাকড়াও করা হবে? তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন,
হে মুয়াজ, জবানের হেফাজত না করার কারণে মানুষকে ওপর করে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। (তিরমিজি ও ইব্ন মাজাহ)
৬. মিথ্যা পরিহার করা : হজরত আব্দুল্লাহ ইব্ন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
যখন কোনো বান্দা মিথ্যা বলে তখন এর দুর্গন্ধে ফেরেস্তারা তার কাছ থেকে এক মাইল দূরে চলে যায়। (তিরমিজি)।
অন্য হাদিসে হজরত মুয়াবিয়া ইব্ন হাইদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি,
দুর্ভোগ তার জন্য, যে লোকদের হাসানোর উদ্দেশ্যে মিথ্যা (গল্প বানিয়ে) বলে। দুর্ভোগ তার জন্য, দুর্ভোগ তার জন্য। (আবু দাউদ)
৭. দোষ চর্চা পরিহার করা : আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন,
তোমরা একে অপরের গীবত (পরনিন্দা) করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? তোমরাতো তা অপছন্দ করে থাক। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর নিশ্চয়ই আল্লাহ অধিক তওবা কবুলকারী অসীম দয়ালু। (সুরা হুজরাত : ১২)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন,
গীবত (পরনিন্দা) জিনার (ব্যভিচার) চেয়ে জগন্য অপরাধ। (বায়হাকি)
সাধারণত আমাদের কথা চার ধরনের হয়।
- ১. পুরো কথাই কল্যাণকর।
- ২. পুরো কথাই ক্ষতিকর।
- ৩. যে কথাতে কল্যাণ-অকল্যাণ মিশ্রিত থাকে।
- ৪. যে কথাতে দুনিয়া-আখেরাতের লাভ-ক্ষতি কিছুই নেই। অর্থাৎ অনর্থক কথা।
কল্যাণকর কথার ক্ষেত্রে শরয়ী বিধান হল পুরোপুরি জেনেশুনে কথা বলা। অনুমান করে কথাবার্তা বলা যাবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন-
যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তার পিছে পড়ো না। জেনে রেখো, কান, চোখ হৃদয়- এর প্রতিটি সম্পর্কে (তোমাদেরকে) জিজ্ঞেস করা হবে। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৩৬
আমাদের অনেকের মাঝেই একটি প্রবণতা খুব লক্ষ করা যায়। আমরা যা শুনি তাই বিশ্বাস করি এবং প্রচার করতে শুরু করি। যাচাই বাছাইয়ের প্রয়োজন বোধ করি না। কোনো তথ্য বা সংবাদ বর্ণনা করার আগে যাচাই-বাছাই করা কর্তব্য। অন্যথায় মিথ্যা হওয়ার প্রবল আশংকা থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
ব্যক্তি যা শুনে তা বর্ণনা করা মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪
যাচাই-বাছাই ছাড়া কথা বলতে থাকা কিংবা সে অনুযায়ী কর্মনীতি নির্ধারণ করতে থাকা চরম বোকামী। পরিণামে তা আক্ষেপের কারণ হয় এবং ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনে। মহান আল্লাহ বলেন-
হে মুমিনগণ! কোনো ফাসেক যদি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে না বস। ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হয়। -সূরা হুজুরাত (৪৯) : ৬
যে কথায় কল্যাণ-অকল্যাণ উভয়টাই রয়েছে, বিশেষ প্রয়োজনে তা বলা যাবে। যেমন, বললে কারো গীবত হয়, না বললে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়- এমন কথা।
ক্ষতিকর ও অনর্থক কথা থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক। মুমিন তো ক্ষতিকর কথা বলতেই পারে না। এসব বলে মুমিন কেন জাহান্নামে যাবে? মুমিন তো অনর্থক কথা থেকেও বেঁচে থাকে। এজন্যে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
যারা অহেতুক বিষয় থেকে বিরত থাকে। -সূরা মুমিনূন (২৩) : ৩
যবানের হেফাযতের গুরুত্ব
যবান অনেক দামী নিআমত, আল্লাহ তাআলার মহা দান। তাই এর নিয়ন্ত্রণ ও যথাযথ ব্যবহার কাম্য। কথায় আছে, দামী জিনিসের হেফাযত কঠিন। স্বর্ণ-রৌপ্য তো মানুষ যত্রতত্র ফেলে রাখে না। সাধ্যের সবটুকু দিয়ে হেফাযতের চেষ্টা করে। আল্লাহ তাআলা যবান হেফাযতের তাকীদ করেছেন এভাবে-
মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত আছে, যে (লেখার জন্য) সদা প্রস্তুত। -সূরা ক্বফ (৫০) : ১৮
যবানে উচ্চারিত সবকিছুই ফেরেশতারা সংরক্ষণ করে রাখেন। ভালো-মন্দ, ছোট-বড় সবকিছুই তাঁরা লিপিবদ্ধ করেন। কিয়ামতের দিন এগুলোর হিসাব দিতে হবে। সেইদিন জিহ্বা, হাত-পাসহ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও সাক্ষী দিবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
যেদিন তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে তাদের বিরুদ্ধে তাদের জিহ্বা, তাদের হাত ও পা সাক্ষ্য দেবে। -সূরা নূর (২৪) : ২৪
আল্লাহ তাআলা বিভিন্নভাবে বান্দাকে সতর্ক করেছেন-
হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্য-সঠিক কথা বল। তাহলে আল্লাহ তোমাদের কার্যাবলী শুধরে দেবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করল সে মহা সাফল্য অর্জন করল। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৭০
আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে তাকওয়া অবলম্বন তথা সব ধরনের নাফরমানী ছেড়ে দিতে বলেছেন। এর সাথে সাথেই যবানের সদ্ব্যবহার তথা সত্য-সঠিক কথা বলতে বলেছেন। কেননা, যবান হল নাফরমানীর বড় হাতিয়ার। তাই তাকওয়ার সাথেই যবানে সত্য-সঠিক কথা বলতে বলেছেন। যবান ঠিক হয়ে গেলে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও সংশোধন হয়ে যাবে। তাই এরপরেই সব আমল সংশোধন ও গুনাহ মাফের ঘোষণা দিয়েছেন।
যবান হেফাযতের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন-
যে আল্লাহ ও শেষ দিবসে বিশ্বাস রাখে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০১৮
একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় সাহাবী ওকবা ইবনে আমের রা.-কে তিনটি ওসিয়ত করলেন। এর প্রথমটি ছিল-
তুমি তোমার জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে রাখ। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪০৬
নবীজী বাচালকে অপছন্দ করেন
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাচালকে অপছন্দ করেন। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
তোমাদের মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় এবং কিয়ামতের দিন আমার সবচেয়ে দূরে থাকবে সে, যে অযথা বেশি কথা বলে এবং যে অহংকার প্রদর্শনের জন্য, দাপট দেখানোর জন্য মুখ ভরে কথা বলে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২০১৮
যবানের অপব্যবহারে কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হওয়া। হাদীস শরীফে এসেছে-
আমি তোমাদেরকে কদরের রাত সম্পর্কে সংবাদ দিতে বের হয়েছিলাম। কিন্তু দুই ব্যক্তির বিতর্কের কারণে আমি তা ভুলে গেছি। তাই তোমরা শেষ দশকে তা অন্বেষণ কর। তেইশ, একুশ, পঁচিশের রাতে।
শবে কদর একটি মহিমান্বিত রজনী। বরকতময় রাত। এ রাতের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে এসেছে- কদরের রাত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম।
যদি একটু বাগবিতণ্ডার কারণে এত বড় সৌভাগ্য লাভ থেকে বঞ্চিত হতে হয় তাহলে আমরা যেভাবে যবানের অপব্যবহার করি যেমন গীবত, পরনিন্দা অপবাদ, মিথ্যা, কটুকথা, গালি ইত্যাদির কারণে আমরা কত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি!
চুপ থাকতে উৎসাহিত করা
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
তুমি যখন চুপ থাকবে তখন নিরাপদেই থাকবে। আর যখন কথা বলবে তখন তা তোমার পক্ষে কিংবা বিপক্ষে যাবে। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ১৩৭
এক দার্শনিকের অভিব্যক্তি- আমি কখনো আমার নীরবতার উপর অনুতপ্ত হইনি। তবে বহুবার কথার কারণে লজ্জিত হয়েছি।
তাই আমাদের উচিত চুপ থাকার অভ্যাস গড়ে তোলা।
যবানের হেফাযতে বেহেশতের যামানত
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যবান হেফাযতের উপর গুরুত্বারোপ করে বলেন-
যে তার যবান ও লজ্জাস্থান হেফাযতের যামানত দিতে পারবে, আমি তার জান্নাতের যামিন হব। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৭৪
নবীজীর যবানের হেফাযত
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জন্য আদর্শ। কথা-বার্তা, চাল-চলন, কাজ-কর্ম সব বিষয়ে তিনি কখনও অযথা অনর্থক কথা বলতেন না, এমনকি বলা পছন্দও করতেন না। শুধু উপকারী ও প্রয়োজনীয় কথা বলতেন। তিনি দীর্ঘসময় নীরব থাকতেন। হাদীসে এসেছে-
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘসময় চুপ থাকতেন এবং কম হাসতেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২০৮১০
অসচেতনতায় যবানের অপব্যবহার
সরাসরি মিথ্যা, গালমন্দ, অশ্লীল কথা এগুলো থেকে আমরা অনেকেই বিরত থাকতে চেষ্টা করি। কিন্তু অনেক সময় বেখেয়ালে মিথ্যা বলে ফেলি। যেমন কিছু দেওয়ার বাহানা করে ছোট বাচ্চাকে ডাকা হল অথচ আহ্বানকারীর কাছে দেওয়ার মত কিছুই নেই। এটি মিথ্যার শামিল।
উম্মে আবদুল্লাহ ইবনে আমের রা. ছোট বাচ্চাকে কিছু দেওয়ার কথা বলে ডাকছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টি লক্ষ করলেন। বললেন, তুমি কি তাকে কিছু দেওয়ার জন্য ডাকছ (নাকি কিছু দেওয়ার বাহানা করে তাকে কাছে ডাকছ?)। তিনি বললেন, হাঁ, আমি তাকে খেজুর দেওয়ার জন্য ডাকছি। তখন নবীজী বললেন-
জেনে রাখ, তুমি যদি তাকে কিছু না দিতে, তাহলে তোমার গুনাহের খাতায় একটি মিথ্যা লেখা হত। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৯১
গল্প-গুজব, হাসি-তামাশা ও রসিকতার ছলে অনেক সময় আমরা অলীক, অবাস্তব ও উদ্ভট কথা বলে ফেলি। এমনকি কখনো কখনো মিথ্যাও হয়ে যায়। এ সমস্যাটি ছোট-বড়, পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে সর্বশ্রেণীর মানুষের মাঝে মহামারির আকার ধারণ করেছে। কারণ রসিকতায় শ্রোতাদের হাসানোই থাকে মুখ্য বিষয়। তাই মিথ্যা, অলীক, অদ্ভুত ও আশ্চর্যজনক কথা বলার প্রবণতা থাকে। এমনকি এসব নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়। অথচ মিথ্যাকে আনন্দ-উল্লাসের মাধ্যম বানানো মারাত্মক গুনাহ। এর পরিণাম অনেক ভয়াবহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ধ্বংস ওর! যে মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে। ধ্বংস ওর! ধ্বংস ওর জন্য!! -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২০০২১
কারো কারো মাঝে কথায় কথায় লানত-বদদোয়া দেওয়ার অভ্যাস থাকে। বিশেষভাবে নারীদের মাঝে। অনেক সময় তারা আপনজন এমনকি নিজ সন্তানকেও বদদোয়া দিয়ে চলে। হতে পারে তখন দুআ কবুলের মুহূর্ত ছিল। ফলে খাল কেটে কুমির আনার মত অবস্থা হয়। বদদোয়াটা লেগে যায়। এটা খুবই গর্হিত কাজ। যবানের মারাত্মক অপব্যবহার। তাই এ ব্যাপারে আমাদের হুঁশিয়ার থাকা উচিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
তোমরা একে অপরকে লানত করো না; বলো না- তোমার উপর আল্লাহর লানত হোক, তোমার উপর আল্লাহর গযব পড়ুক, তুমি জাহান্নামে যাও। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৭৬
যবানের অপব্যবহারের আরেকটি ক্ষেত্র হল, ঠাট্টা-বিদ্রূপ, গীবত-অপবাদ ইত্যাদি। আমাদের কারো কারো কথাবার্তার বড় একটা অংশ থাকে তৃতীয় ব্যক্তিকে নিয়ে। হয়ত কারো দোষ চর্চা করা, না হয় কাউকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা অথবা কারো ব্যাপারে মন্দ বলা বা অপবাদ আরোপ করা। অথচ কুরআন-হাদীস এগুলো থেকে শক্তভাবে বারণ করেছে। এগুলো প্রত্যেকটাই কবীরা গুনাহ। পাশাপাশি যবানের অপব্যবহারেরও শামিল।
যবানের অপব্যবহারের পরিণাম
যবানের অপব্যবহার মানুষকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। দীর্ঘ এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত মুআয রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন- কথার কারণেও কি আমাদের পাকড়াও করা হবে? (মুখের কথার কারণেও কি জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে?)
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুআজ রা.-এর উরুতে মৃদু আঘাত করে বললেন-
হে মুআয! তুমি এ বিষয়টি বুঝ না! আরে, মানুষকে তো তার যবানের কথাই উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। যে আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী সে যেন ভালো কথা বলে বা অন্তত মন্দ কথা থেকে বিরত থাকে। তোমরা ভালো কথা বল, লাভবান হবে। মন্দকাজ থেকে বিরত থাক, নিরাপদ থাকবে। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৭৭৪
যবানের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যবানের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। কত পুত-পবিত্র তাঁর যবান! যে যবান আল্লাহর তরফ থেকে বান্দার কাছে ওহী পৌঁছায় এবং আল্লাহর কালামের ব্যাখ্যা দান করে। এ যবানের পবিত্রতা স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন-
সে তার নিজ খেয়াল-খুশি থেকে কিছু বলে না। এ তো ওহী, যা তার কাছে পাঠানো হয়। -সূরা আননায্ম (৫৩) : ৩-৪]
তা সত্তে¡ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিনয়কাতর হয়ে আল্লাহ্র কাছে যবানের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন-
হে আল্লাহ! আমি আমার কান, চোখ, যবান, হৃদয় এবং লজ্জাস্থানের অনিষ্ট থেকে আপনার আশ্রয় চাই। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫৫১; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৯২
আমাদের উচিত যবানের সঠিক ব্যবহারের প্রতি সচেতন ও যত্নবান হওয়া এবং এর অনিষ্ট থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করা।
জবানের হেফাজত জান্নাতের সুসংবাদ দেয়
একজন উত্তম মুসলিমের পরিচয় দিতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
যার হাত ও জবান (মুখ) থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে তিনিই হলেন প্রকৃত মুসলিম। (বুখারি-০৯)।
প্রতিটি দ্বীনদার মুসলিমের জন্য তার জীবনের সর্বক্ষেত্রে জিহবা তথা তার জবান বা মুখের ব্যবহারকে সংযত করা অত্যন্ত জরুরি বিষয়।
হজরত সাহল ইবনে সাদ (রা.) রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন,
যে ব্যক্তি আমার জন্য দুই চোয়াল আর দুই রানের মধ্যবর্তী (জিহবা ও লজ্জা স্থানের) হেফাজতের দায়িত্ব নিবে,আমি তার জন্য জান্নাতের দায়িত্ব নেবো। (বুখারি-৬৪৭৪)
মুসলিম শুধুমাত্র কল্যাণ আছে এমন বিষয়েই কথা বলবে। এমনকি কল্যাণ লাভের বিচারে যদি কথা বলা বা না বলা সমান হয়ে থাকে তবে সেক্ষেত্রে চুপ থাকা সুন্নাত। কারণ স্বাভাবিক কথাবার্তাও ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন আর হাজারো চেষ্টা করে শান্তি ফিরিয়ে আনা যায় না।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন,
যে ব্যক্তি আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের প্রতি ইমান এনেছে, সে যেন উত্তম বা ভালো কথা বলে বা চুপ থাকে। (মুসলিম-৪৭)।
জিহবা বা জবান কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ এটা বর্ণনা করে বুঝানো অসম্ভব। জিহবা মানব জীবনের গতিপথকে সঠিকভাবে পরিচালনা করে। আমাদের সালফে সালেহীনরা জিহবাকে সবচেয়ে বেশি ভয় করতেন।
একদিন হজরত ওমর (রা.) দেখলেন, আবু বকর সিদ্দিক (রা.) নিজেই নিজের জিহবা বের করে হাত দিয়ে টেনে ধরেছেন। ওমরা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, হে খলিফাতুল মুসলিমিন, আপনি কি করছেন? জবাবে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বললেন, ‘এটাই আমাকে ধ্বংসের স্থানে নিক্ষেপ করেছে‘।
ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেছেন, মানুষ যখন কথা বলতে চায়, তখন তার উচিৎ কথা বলার আগে ভেবে নেওয়া। কল্যাণ আছে একদম শতভাগ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো কথা বলবে না।
ইমাম নববী রহ. বলেছেন, কোনো মুসলিমের জন্য এমন কথা বলা বলা সমীচীন নয়; যাতে কোনো উপকার বা কল্যাণ নেই। কোনো মুসলিম সন্দিহান বিষয়েও কথা বলবে না বরং শতভাগ নিশ্চিত হয়ে তারপর কথা বলবে।
একজন ইসলামী পন্ডিত বলেছিলেন, মানুষের মধ্যে আট হাজারেরও বেশি দোষ খুঁজে পাওয়া গেছে। তবে একটি জিনিস আমি খুঁজে পেয়েছি যেটার আমল করলে তার সব দোষ গোপন থাকবে আর সেটি হলো জবান বা মুখের হেফাজত।
কিছু কিছু আলিম জিহবাকে হিংস্র প্রাণীর সাথে তুলনা করেছেন। তারা বলেছেন, জিহবাকে বেঁধে রাখো নতুবা সে তোমাকেই আক্রমণ করবে। এই জিহবা বা জবান বীর পালোয়ানকেও পরাস্ত করে দাবিয়ে দিতে পারে এক মুহুর্তেই।
সংগৃহীত