ইদরীস (আঃ) ছিলেন একজন বিখ্যাত নবী। তাঁর নামে বহু উপকথা তাফসীরের কিতাবসমূহে বর্ণিত হয়েছে। যে কারণে জনসাধারণ্যে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। হযরত ইদরীস (আঃ) হযরত নূহ (আঃ)-এর পূর্বের নবী ছিলেন, না পরের নবী ছিলেন এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে অধিকাংশ ছাহাবীর মতে তিনি নূহ (আঃ)-এর পরের নবী ছিলেন। সূরা মারিয়ামে হযরত ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক্ব, ইয়াকূব, হারূণ, মূসা, যাকারিয়া, ইয়াহ্ইয়া, ঈসা ইবনে মারিয়াম ও ইদরীস (আঃ)-এর আলোচনা শেষে আল্লাহ বলেন,

‘এঁরাই হ’লেন সেই সকল নবী, যাদেরকে নবীগণের মধ্য হ’তে আল্লাহ বিশেষভাবে অনুগৃহীত করেছেন। এঁরা আদমের বংশধর এবং যাদেরকে আমরা নূহের সাথে নৌকায় আরোহণ করিয়েছিলাম তাদের বংশধর এবং ইবরাহীম ও ইসরাঈল (ইয়াকূব)-এর বংশধর এবং যাদেরকে আমরা (ইসলামের) সুপথ প্রদর্শন করেছি ও (ঈমানের জন্য) মনোনীত করেছি তাদের বংশধর। তাদের কাছে যখন দয়াময় আল্লাহর আয়াত সমূহ পাঠ করা হত, তখন তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ত ও ক্রন্দন করত’ (মারিয়াম ১৯/৫৮)

অত্র আয়াতে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ইদরীস (আঃ) হযরত নূহ (আঃ)-এর পরের নবী ছিলেন। তবে নূহ ও ইদরীস হযরত আদম (আঃ)-এর নিকটবর্তী নবী ছিলেন, যেমন ইবরাহীম (আঃ) হযরত নূহ (আঃ)-এর নিকটবর্তী এবং ইসমাঈল, ইসহাক্ব ও ইয়াকূব হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকটবর্তী নবী ছিলেন। নূহ পরবর্তী সকল মানুষ হ’লেন নূহের বংশধর।

কুরতুবী বলেন, ইদরীস (আঃ)-এর নাম ‘আখনূখ’ ছিল এবং তিনি হযরত নূহ (আঃ)-এর পরদাদা ছিলেন বলে বংশবিশারদগণ যে কথা বলেছেন, তা ধারণা মাত্র। এমনিভাবে অন্যান্য নবীদের যে দীর্ঘ বংশধারা সাধারণতঃ বর্ণনা করা হয়ে থাকে, সে সবের কোন সঠিক ভিত্তি নেই। এসবের প্রকৃত ইল্ম কেবলমাত্র আল্লাহর নিকটে রয়েছে। ইদরীস (আঃ)-কে ৩০টি ছহীফা প্রদান করা হয়েছিল বলে হযরত আবু যর গেফারী (রাঃ) থেকে ইবনু হিববানে (নং ৩৬১) যে বর্ণনা এসেছে, তার সনদ যঈফ।

হযরত ইদরীস (আঃ) হ’লেন প্রথম মানব, যাঁকে মু‘জেযা হিসাবে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও অংকবিজ্ঞান দান করা হয়েছিল। তিনিই সর্বপ্রথম মানব, যিনি আল্লাহর ইলহাম মতে কলমের সাহায্যে লিখন পদ্ধতি ও বস্ত্র সেলাই শিল্পের সূচনা করেন। তাঁর পূর্বে মানুষ সাধারণতঃ পোশাক হিসাবে জীবজন্তুর চামড়া ব্যবহার করত। ওযন ও পরিমাপের পদ্ধতি তিনিই সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন এবং লোহা দ্বারা অস্ত্র-শস্ত্র তৈরীর পদ্ধতি আবিষ্কার ও তার ব্যবহার তাঁর আমল থেকেই শুরু হয়। তিনি অস্ত্র নির্মাণ করে ক্বাবীল গোত্রের বিরুদ্ধে জেহাদ করেন।

এক আগন্তুক ব্যক্তি তিনদিন পর্যন্ত হযরত ইদ্রিস (আঃ) এর সহচর্যে থাকলেন। তার আচরণাদি লক্ষ্য করে হযরত ইদ্রিস (আঃ)-এর মনে সন্দেহের উদ্রেক হলো যে, এ ব্যক্তি নিশ্চয় কোন মানুষ নয়। অতএব তিনি বললেন, আল্লাহর কসম আপনি আপনার প্রকৃত পরিচয়টা বলুন। আগন্তুক বলল, আমি কোন মানুষ নয়। আমি একজন ফেরেশতা। আমার নাম মালাকুল-মওত আজরাঈল (আঃ)।

হযরত ইদ্রিস (আঃ) বললেন, আপনিই কি দুনিয়ার যাবতীয় প্রাণীর জান কবজ করিয়া থাকেন? মালাকুল-মওত বললেন, হ্যাঁ। হযরত ইদ্রিস (আঃ) তাকে আবারও জিজ্ঞাসা করলেন, তবে মনে হয় আপনি আমার জান কবজ করতেই এসেছেন।

মালাকুল-মওত বললেন, না, আপনার সাথে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করতে এসেছি। আমার একান্ত বাসনা আপনিও আমার এ প্রস্তাবে রাজী হবেন’।

হযরত ইদ্রিস (আঃ) বললেন, আমি আপনার সাথে এক শর্তে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করতে রাজী যদি আপনি আমাকে একবার মৃত্যুর অবস্থাটা উপভোগ করান। যদি আপনি আমাকে এখনই একবার মৃত্যুর অবস্থাটা উপভোগ করান তাহলে আমার অনেক উপকার হতো। মৃত্যুর ভয়ে আমি বেশি করে আল্লাহর ইবাদত করতে পারতাম।

মালাকুল-মওত বললেন, আল্লাহর অনুমতি ছাড়া আমি একাজ করতে পারিনা। আল্লাহ এখনো আপনার জান কবজ করার হুকুম আমাকে দেননি। হযরত ইদ্রিস (আঃ) বললেন, আপনি আল্লাহর নিকট হতে অনুমতি চেয়ে নিন।

মালাকুল-মওত আল্লাহর নিকট অনুমতি প্রার্থনা করলে আল্লাহ তাঁকে অনুমতি দেন। অনুমতি পেয়ে মালাকুল-মওত হযরত ইদ্রিস (আঃ) এর জান কবজ করলেন। জান কবজ করার পর মালাকুল-মওত আজরাঈল (আঃ) পুনঃরায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন হযরত ইদ্রিস (আঃ) এর জান ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা কবুল করলেন।

অতঃপর ফেরেশতা আজরাঈল (আঃ) হযরত ইদ্রিস (আঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন, ভাই ইদ্রিস! জান কবজ করার সময় আপনার কেমন অনুভূতি হয়েছিল? হযরত ইদ্রিস (আঃ) বললেন, কোন জীবিত প্রাণীর শরীরের চামড়া মাথা হতে পা পর্যন্ত খসে তুলে ফেললে প্রাণীটির যে রূপ কষ্ট হয় আমারও তেমনই কষ্ট হয়েছে।

মালাকুল-মওত বললেন, ভাই ইদ্রিস! আমি আজ পর্যন্ত যত জান কবজ করেছি এত সহজে কারো জান কবজ করিনি।

হযরত ইদ্রিস (আঃ) হযরত আজরাঈল (আঃ) কে বললেন, আমার মনে দোজখ দেখার খুব স্বাদ জেগেছে। যদি আপনি আমাকে দোজখ দেখাতেন তবে আমি দোজখের ভয়ে ইবাদত-বন্দেগীতে আরও বেশি মনোযোগী হতে পারতাম।

মালাকুল-মওত তাঁকে দোজখ দেখাতে দোজখের দরজায় নিয়ে গেলেন। তিনি দোজখ দেখার পর বললেন, ভাই আজরাঈল! আমার মনে বেহেশত দেখার বড়ই স্বাদ জেগেছে। যদি আপনি আমার এই স্বাদটি পূর্ণ করতেন তাহলে আপনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকতাম।

মালাকুল-মওত বললেন, যদি আপনি আমাকে কথা দেন যে বেহেশত দেখেই আপনি আমার নিকট ফিরে আসবেন তাহলে আমি আপনাকে বেহেশত দেখাতে পারি।

হযরত ইদ্রিস (আঃ) তাতে রাজী হলে মালাকুল-মওত তাঁকে বেহেশত দেখাতে নিয়ে গেল। বেহেশতের দরজায় আসলে হযরত ইদ্রিস (আঃ) তাঁর পায়ের জুতা খুলে বেহেশতে প্রবেশ করলেন। তিনি কিছু সময় বেহেশতে ঘুরাফেরা করলেন। এরপর তিনি মালাকুল-মওতের কাছে ফিরে এসে নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলেন। পরক্ষণেই তিনি এক দৌঁড়ে আবার বেহেশতে ঢুকে গেলেন। মালাকুল-মওত তাঁকে ডেকে বলল, ভাই ইদ্রিস! আপনি আবার বেহেশতে ঢুকলেন কেন? তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসুন। আমি আপনাকে আবার পৃথিবীতে পৌঁছে দেব।

হযরত ইদরিস (আঃ) বেহেশতের ভিতর থেকে জবাব দিলেন, ভাই আজরাঈল! আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন – প্রত্যেক প্রাণীই একবার মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে এবং একবার দোজখ না দেখে কেউ বেহেশতে যেতে পারবেনা। আমি তো একবার মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করলাম এবং দোজখও দেখলাম। তারপর বেহেশত হতে বের হয়ে আপনাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করলাম। অতএব এখন আমি আর বেহেশত হতে বের হবো না। আপনি আপনার কাজে চলে যেতে পারেন।

মালাকুল-মওত হযরত ইদ্রিস (আঃ) এর জবাব শুনে কর্তব্য স্থির করতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইলেন। আল্লাহ তা’আলা তখন হযরত আজরাঈল (আঃ) কে লক্ষ্য করে বললেন, আজরাঈল! ইদ্রিসকে বেহেশতে থাকতে দাও। তাঁর ভাগ্যে আমি এরূপ ঘটনায় লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলাম। অতঃপর হযরত ইদ্রিস (আঃ) মহাসুখে বেহেশতে বসবাস করতে লাগলেন।

সংগৃীত

https://youtu.be/4wdy6eyyTS4?si=ajHIoesU8WXi_nlX
https://youtu.be/Qe9ylM6fNYM?si=qMKBme-o3ieHCyWN
https://youtu.be/JbfiGTYGcTc?si=okH7I3MTHQllXPA9
Views: 111