মানুষ একে অপরের সাথে বিভিন্ন সম্পর্কে জড়িত। মানুষের মাঝের এই সম্পর্কের নাম হচ্ছে ‘আত্মীয়তা’। পরস্পরের সাথে জড়িত মানুষ হচ্ছে একে অপরের ‘আত্মীয়’। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে আত্মীয়তার সম্পর্ক সর্বতোভাবে জড়িত। আত্মীয় ছাড়া এ জীবন অচল। আত্মীয়দের সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও ভালবাসা নিয়েই মানুষ এ পার্থিব জীবনে বেঁচে থাকে। আর আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় না থাকলে জীবন হয়ে যায় নীরস, আনন্দহীন, একাকী ও বিচ্ছিন্ন।

আত্মীয়র পরিচয় :

‘আত্মীয়’ শব্দের অর্থ হচ্ছে স্বজন, জ্ঞাতি, কুটুম্ব। এর আরবী প্রতিশব্দ হচ্ছে الرَّحِمُ (আর-রাহিমু) বা ذُو الرَّحِمِ (যুর রাহিমে)। আত্মীয়তা-এর ইংরেজী প্রতিশব্দ হচ্ছে Relationship. এর সংজ্ঞায় Oxford অভিধানে বলা হয়েছে The way in which two people, groups or countries behave towards each other or deal with each other. অর্থাৎ এমন পথ-পন্থা যাতে দু’ব্যক্তি, দল বা দেশ পরস্পরের সাথে সদাচরণ করে বা পরস্পরে আলোচনা করে’।

আত্মীয়তার সম্পর্কের তাৎপর্য :

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার অর্থ ও তাৎপর্য হচ্ছে স্বজন ও আপনজনের সার্বিক খোঁজ-খবর রাখা ও তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করা।

আত্মীয়তার প্রকার :

আত্মীয় প্রধানত দু’প্রকার। যথা-

(১) রক্ত সম্পর্কীয় বা বংশীয়। যেমন পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, ভাইবোন, চাচা-চাচী, মামা-খালা ইত্যাদি।

(২) বিবাহ সম্পর্কীয়। যেমন শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, শ্যালক-শ্যালিকা ইত্যাদি।

যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমরা অচিরেই মিসর জয় করবে। সেটা এমন একটি ভূমি যাকে ‘কবীরাত্ব’ বলা হয়। অর্থাৎ যেখানে দীনার-দিরহামের প্রাচুর্য রয়েছে। যখন তোমরা সেটা জয় করবে, তখন সেখানকার অধিবাসীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করবে। কেননা তাদের জ্ঞাতি সম্পর্ক রয়েছে। অথবা তিনি বলেছেন, বংশীয় ও বৈবাহিক সম্পর্ক রয়েছে’। অর্থাৎ ইসমাঈল (আঃ)-এর মাতা হাজেরার দিক দিয়ে বংশীয় বা রক্ত সম্পর্ক এবং রাসূলপত্নী মারিয়া কিবতিয়ার দিক দিয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক।

পরিত্যক্ত সম্পদের অধিকারী হওয়ার দিক দিয়ে আত্মীয় দু’প্রকার।

(১) উত্তরাধিকারী; যেমন- পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা প্রভৃতি

(২) উত্তরাধিকারী নয়; যেমন- চাচা-চাচী, মামা-খালা ইত্যাদি।

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার হুকুম :

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার হুকুম ফরয, সুন্নাত ও বৈধ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে অবস্থার প্রেক্ষিতে এবং আত্মীয়দের ভিন্নতার কারণে। তবে সাধারণভাবে সবার সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখা ওয়াজিব এবং সম্পর্ক ছিন্ন করা সকলের ঐক্যমতে হারাম। তবে কারো কারো নিকটে কবীরা গোনাহ।

(১) ফরয : পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা ফরয। কেননা আল্লাহ বলেন,

‘আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে’ (আনকাবূত ২৯/৮)

মহান আল্লাহ আরো বলেন,

‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করতে ও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হ’লে তাদেরকে উফ বল না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বল’, মমতাবশে তাদের প্রতি নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত কর এবং বল, ‘হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া কর যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন’ (ইসরা ১৭/২৩-২৪)

পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারে হাদীছে অনেক নির্দেশ এসেছে। আর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করাকে বড় গোনাহ বলা হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিনবার বললেন,

‘আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহগুলো সম্পর্কে অবহিত করব না? সকলে বললেন, হ্যাঁ, বলুন হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক করা এবং পিতা-মাতার অবাধ্যতা। অতঃপর তিনি হেলান দেওয়া থেকে সোজা হয়ে বসলেন। এরপর বললেন, সাবধান, মিথ্যা কথা বলা’।

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, এক বেদুইন নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কবীরা গুনাহসমূহ কি? তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সাথে শরীক করা’। সে বলল, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘পিতামাতার অবাধ্যতা। সে বলল, তারপর কোন্টি? তিনি বললেন, ‘মিথ্যা শপথ করা’। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মিথ্যা শপথ কি? তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা (শপথের সাহায্যে) মুসলিমের ধন-সম্পদ হরণ করে নেয়’।

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন আমল আল্লাহর নিকটে অধিক প্রিয়। তিনি বললেন, যথাসময়ে ছালাত আদায় করা। ইবনু মাসউদ (রাঃ) বললেন, অতঃপর কোনটি? তিনি বললেন, অতঃপর পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা। তিনি বললেন, অতঃপর কোন্টি? রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা’।

অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বললেন,

‘তার নাক ধূলায় ধুসরিত হোক। তার নাক ধূলায় ধুসরিত হোক। তার নাক ধূলায় ধুসরিত হোক’। বলা হ’ল, কার হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)? তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি তার পিতামাতার একজনকে অথবা উভয়কে বার্ধক্যে পেল, কিন্তু (তাদের সেবা করে) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না’।

(২) সুন্নাত : অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা সুন্নাত। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশকারী আমল সম্পর্কে অবহিত করতে গিয়ে বলেন, ‘তুমি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করবে’।

(৩) মানদূব বা বৈধ : কাফির-মুশরিক পিতা-মাতার সাথে সন্তানের সুসম্পর্ক বজায় রাখা বৈধ। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করবে’ (লোক্বমান ৩১/১৫)

আসমা বিনতে আবূ বকর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,.

‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে আমার মা মুশরিক অবস্থায় আমার নিকট আসলেন। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট ফৎওয়া জিজ্ঞেস করলাম, আমার মা আমার নিকটে এসেছেন, তিনি আমার প্রতি (ভাল ব্যবহার পেতে) খুবই আগ্রহী, এমতাবস্থায় আমি কি তার সঙ্গে সদাচরণ করব? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি তোমার মায়ের সাথে সদাচরণ কর’।

আত্মীয়দের মাঝে মর্যাদা বা স্তরের ভিন্নতা :

বংশীয় দিক দিয়ে নিকটাত্মীয় হচ্ছেন পিতা-মাতা। তবে এর মধ্যে মায়ের স্তর ঊর্ধ্বে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আমরা তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। জননী সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ান হয় দুই বৎসরে। সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই নিকট’ (লোক্বমান ৩১/১৪)

হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক লোক রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে এসে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার নিকট কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিক হকদার? তিনি বললেন, ‘তোমার মা’। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, ‘তোমার মা’। সে বলল, অতঃপর কে? তিনি বললেন, ‘তোমার পিতা’।

অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের উপর হারাম করেছেন মায়ের অবাধ্যতা বা নাফরমানী, কন্যা সন্তানকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা, কারো প্রাপ্য না দেয়া এবং অন্যায়ভাবে কিছু নেয়া। আর অপছন্দ করেছেন অনর্থক বাক্য ব্যয়, অধিক প্রশ্ন করা এবং মাল বিনষ্ট করা’।

নিকটাত্মীয়ের মধ্যে ভাই-বোনও অন্তর্ভুক্ত। তবে ভাই-বোন বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় হয়ে থাকে। আবার সম্পর্কের কারণে তারা দূরবর্তীও হয়। যেমন চাচাত, মামাত, খালাত, ফুফাত ভাই।

আবার স্থানের দূরত্বের কারণেও স্তরের ভিন্নতা হয়। যেমন- নিজ মহল্লা ও নিজ শহরে বসবাসকারী আত্মীয় নিকটের। পক্ষান্তরে ভিন্ন মহল্লায় ও ভিন্ন শহরে বসবাসকারী আত্মীয় দূরের অন্তর্ভুক্ত। তবে রক্ত বা বংশ সম্পর্কিত আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা জরূরী অন্যদের অপেক্ষা। এখানে সময়ের কোন নির্ধারিত সীমা নেই। আজীবন এ সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।

প্রকৃত জ্ঞাতি সম্পর্ক :

কোন ব্যক্তি যখন তার কোন আত্মীয়ের সাক্ষাৎ করার কারণে ঐ আত্মীয়ের সাথে সাক্ষাৎ করে, এটাকে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা বলে না। বরং এটা হচ্ছে প্রতিদান স্বরূপ। অনুরূপভাবে যদি কোন কাজে সহযোগিতা ও প্রয়োজন পূর্ণ করা হয় আত্মীয়ের অনুরূপ কাজের বিনিময়ে তাহ’লে এটাকেও আত্মীয়তা রক্ষা করা বলা হবে না। এটাও হচ্ছে প্রতিদান বা বিনিময়। বরং প্রকৃত আত্মীয়তা রক্ষা হচ্ছে সম্পর্ক ছিন্ন করা হ’লেও যে তা বজায় রাখে। আত্মীয় দুর্ব্যবহার করলেও যে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে, খোঁজ-খবর নেয়, তারা তার সাথে অসদাচরণ করলেও সে উত্তম আচরণ করে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন,

‘প্রতিদানকারী আত্মীয়তার হক সংরক্ষণকারী নয়। বরং আত্মীয়তার হক সংরক্ষণকারী সে ব্যক্তি, যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হবার পরও তা বজায় রাখে।

অন্য হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একদা এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করল,

‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (ছাঃ)! আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন রয়েছে, আমি তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করি, কিন্তু তারা আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। আমি তাদের প্রতি অনুগ্রহ করি কিন্তু তারা আমার সাথে অসদাচরণ করে। তারা আমার সাথে গোয়ার্তুমি করে। আমি সহ্য করে যাই। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘যদি তোমার বক্তব্য ঠিক হয়, তবে তো তুমি যেন তাদের মুখে উত্তপ্ত ছাই পুরে দিচ্ছ। তোমার কারণে তাদের দুর্ভোগ আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি এরূপ করতে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ হ’তে একজন সাহায্যকারী তাদের মুকাবিলায় তোমার সাথে থাকবেন’।

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার পদ্ধতি ও উপায় :

তাদের সাথে সাক্ষাৎ করা, তাদের অবস্থা সম্পর্কে লক্ষ্য রাখা এবং তাদের খোঁজ-খবর নেওয়া। তাদেরকে উপহার-উপঢৌকন প্রদান করা, তাদের যথাযথ সম্মান করা ও মর্যাদা দেওয়া। তাদের মধ্যে যারা দরিদ্র তাদেরকে দান করা।

আত্মীয়-স্বজন বাড়ীতে আসলে তাদেরকে সানন্দে গ্রহণ করা ও যথাসাধ্য আপ্যায়ন করা এবং মাঝেমধ্যে বাড়ীতে আমন্ত্রণ করা। তাদের কোন অভিযোগ থাকলে তা শোনা ও দূর করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা। সর্বোপরি তাদের মর্যাদাকে সবার উপরে স্থান দেওয়া।

তাদের সুসংবাদে শরীক হওয়া এবং দুঃসংবাদে সহমর্মী ও সমব্যথী হওয়া। তাদের নিরাপত্তা ও সংশোধনের জন্য দো‘আ করা। বিবদমান বিষয় দ্রুত মীমাংসা করা এবং সম্পর্কোন্নয়ন ও মযবূত করণের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখা।

আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কেউ অসুস্থ হ’লে তাকে দেখতে যাওয়া এবং সাধ্যমত তার সেবা-শুশ্রূষা করা। কোন আত্মীয় দাওয়াত দিলে তার দাওয়াত কবুল করা।

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, তাদের হেদায়াতের চেষ্টা করা, সঠিক পথের দিকে তাদেরকে দাওয়াত দেওয়া। সেই সাথে তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেওয়া ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা, বাধা দেওয়া। আত্মীয়-স্বজন সৎ কর্মশীল হ’লে এবং সঠিক পথে থাকলে এ সম্পর্ক অব্যাহত থাকে। পক্ষান্তরে আত্মীয়-স্বজন কাফের বা পাপাচারী হ’লে তাদেরকে উপদেশ দেওয়া এবং তাদের হেদায়াতের জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখা।

যদি কোন আত্মীয়ের মধ্যে অহংকার, আত্মগৌরব, শত্রুতা ও বিরোধীভাব পরিলক্ষিত হয় অথবা কেউ যদি এই আশংকা করে যে, তার কোন আত্মীয় তাকে প্রত্যাখ্যান করবে ও তার সাথে বাড়াবাড়ি করবে, তাহ’লে তার সাথে নম্রতা অবলম্বন করা অথবা তাদের থেকে এমনভাবে দূরত্ব বজায় রাখা যে, সেটা যেন তাদের কোন কষ্টের কারণ না হয়। আর তাদের জন্য অধিক দো‘আ করা, যাতে আল্লাহ তাদের হেদায়াত করেন। আত্মীয়দের কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার জানাযায় শরীক হওয়া।

সর্বোপরি আত্মীয়-স্বজনের সাথে নম্র ব্যবহার এবং তাদের সাথে সদ্ভাব-সম্প্রীতি স্থাপন ও পরস্পর ভালবাসার সৃষ্টির মাধ্যমে এ সম্পর্ক অটুট রাখা যায়।

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব :

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা অতি জরূরী। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোন কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না। পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর-প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পসন্দ করেন না দাম্ভিক, অহংকারীকে’ (নিসা ৪/৩৬)

অন্যত্র তিনি বলেন,

‘আর আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা এক অপরের নিকট যাচ্ঞা কর এবং তোমরা সতর্ক থাক জ্ঞাতি-বন্ধন সম্পর্কে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবেন’ (নিসা ৪/১)

মহান আল্লাহ আরো বলেন,

‘আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আদেশ করেছেন যারা তা অক্ষুণ্ণ রাখে, ভয় করে তাদের প্রতিপালককে এবং ভয় করে কঠোর হিসাবকে’ (রা‘দ ১৩/২১)

‘স্মরণ কর, যখন আমরা বানী ইসরাঈলের অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করবে না, পিতামাত, আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন ও দরিদ্রদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে’ (বাক্বারাহ ২/৮৩)

‘তবে কি (হে মুনাফিক সমাজ!) তোমরা আধিপত্য লাভ করলে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন সমূহকে ছিন্ন করবে?’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২২)

‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন’ (নাহল ১৬/৯০)

‘আত্মীয়কে তার অধিকার প্রদান কর’ (বনী ইসরাঈল ১৭/২৬; রূম ৩১/৩৮)

হাদীছেও আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারে অনেক তাকীদ এসেছে। যেমন- আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, ‘তোমার নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক কর’ (শু‘আরা ২৬/২১৪) তখন নবী করীম (ছাঃ) ডাক দিলেন, হে বনী কা‘ব ইবনু লুই! নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন হ’তে রক্ষা কর! হে আবদে মানাফ গোত্রীয় লোকজন! নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন হ’তে রক্ষা কর! হে হাশেম বংশীয়রা! নিজেদেরকে আগুন হ’তে রক্ষা কর! হে আব্দুল মুত্তালিবের বংশের লোকজন! নিজেদেরকে আগুন হ’তে রক্ষা কর! হে মুহাম্মাদ তনয়া ফাতেমা! নিজেকে আগুন হ’তে রক্ষা কর! নতুবা আমি তোমাকে আল্লাহর কোপানল হ’তে রক্ষা করতে পারব না, আমার করার কিছুই থাকবে না; কেবল তোমরা যে আমার রক্তের বন্ধনে বাঁধা, এই যা আমি আমার রক্তের হক আদায় করি’।

আত্মীয়ের জানাজায় অংশগ্রহণ :

আত্মীয়ের মধ্যে কেউ ইন্তেকাল করলে তার জানাজায় অংশগ্রহণ করা নৈতিক দায়িত্ব। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন-

‘যে ব্যক্তি ইমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় কোনো মুসলমানের জানাজায় আসে এবং তার জানাজার সালাত আদায় ও দাফন সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত সাথে থাকে, সে দুই ক্বিরাত সওয়াব নিয়ে প্রত্যাবর্তন করবে।’ (বুখারি)

আত্মীয়-স্বজনের ৬ অধিকার

আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি রিজিক (জীবিকা) প্রশস্ত হওয়ার এবং আয়ু বৃদ্ধির প্রত্যাশা করে সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ন রাখে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৯৮৬)
আলোচ্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসরা বলেন, ‘এখানে জীবিকা ও আয়ুষ্কাল বৃদ্ধির অর্থ হলো বরকত লাভ করা। ভালো কাজের সুযোগ হওয়া। সময় যথাযথ কাজে লাগানো এবং অপচয় ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া।’ (জাওয়াহিরুল হারিরিয়্যা : ২/৩৫২) 
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার বিধান

ইসলামী শরিয়তে প্রত্যেকের সাধ্যানুযায়ী আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ওয়াজিব। তবে সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে অধিক নিকটতম আত্মীয়রা অগ্রাধিকার পাবে। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন,

‘যারা সেই সম্পর্ক রক্ষা করে, যা রক্ষার নির্দেশ আল্লাহ দিয়েছেন।’ (সুরা : রাদ, আয়াত : ২১)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার রক্তের সম্পর্ক বজায় রাখে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬১৩৮)

আত্মীয়তার অধিকার

আল্লাহ মানুষের ভেতর যে পারস্পরিক সম্পর্ক দান করেছেন তার রক্ষা ও আত্মীয়-স্বজনের অধিকার আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনেই ইরশাদ হয়েছে, ‘আর নিকটাত্মীয়ের অধিকার রক্ষা করো।’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৬)

১. যোগাযাগ রক্ষা করা : আত্মীয়রা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবে।

এমনকি কেউ বিচ্ছিন্ন থাকলেও তার সঙ্গে অন্যরা যোগাযোগ রক্ষা করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
‘… প্রকৃত আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী সেই যে ব্যক্তি তার আত্মীয় তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও সে তা রক্ষা করে চলে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৯৯১)২.
২. ভালো আচরণ করা : পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,
‘মা-বাবার সঙ্গে উত্তম আচরণ করো, আর উত্তম আচরণ করো নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৩৬)
৩. অভাবগ্রস্ত হলে সহযোগিতা করা : অভাবগ্রস্ত আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতার তাগিদ দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
‘কোনো মিসকিনকে দান করলে শুধু দানের সওয়াব আর আত্মীয়কে সহযোগিতা করলে দুটি সওয়াব—দান ও আত্মীয়তা রক্ষা।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২৫৮২)
৪. মেহমানদারি করা : মেহমানদারি সাধারণ মুসলমানের অধিকার।
আত্মীয় হলে তা আরো দৃঢ় হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে সে যেন মেহমানকে সম্মান করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬১৩৮)
৫. অসুস্থ হলে সেবা করা : আত্মীয়-স্বজন অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া এবং খোঁজখবর নেওয়া আবশ্যক। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে আহার করাও, রোগীর শুশ্রূষা করো এবং বন্দিদের মুক্ত করো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৩৭৩)৬. দ্বিনের ব্যাপারে সতর্ক করা : আত্মীয়রা পরস্পরের জাগতিক কল্যাণ কামনার মতো পরকালীন কল্যাণের ব্যাপারে সচেতন ও সতর্ক করবেন। কেননা আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা নিজেদেরকে এবং পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করো জাহান্নামের আগুন থেকে, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর।’ (সুরা : তাহরিম, আয়াত : ৬)

আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার উপায়সমূহ

১. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করলে দুনিয়া ও আখিরাতের যে যে লাভগুলো পাওয়া যায় তা সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, কোনো বস্ত্তর ফলাফল ও পরিণতি জানলেই তা করার সদিচ্ছা জন্মে এবং তা করতে মানুষ অধিক আগ্রহী হয়।

২. আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার ভয়ানক পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে। কারণ, তা ব্যক্তি জীবনে একদা বিশেষ চিন্তা, বিষণ্ণতা, লজ্জা ও আফসোস বয়ে আনে। কেননা, কোনো জিনিসের ভয়ানক পরিণতির কথা জানা থাকলেই তো তা থেকে দূরে থাকা একদা সহজ হয়।

৩. এ ব্যাপারে সর্বদা আল্লাহ তা‘আলার একান্ত সহোযোগিতা কামনা করবে। কারণ, একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই বান্দাহ্’র সকল কাজ সহজ করে দিতে পারেন।

৪. আত্মীয়-স্বজনদের দুর্ব্যবহারকে আপনি নিজ ভালো ব্যবহার ও দয়া দিয়ে মোকাবিলা করবেন।

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা জনৈক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে উদ্দেশ্য করে বলেন, হে আল্লাহ্’র রাসূল! আমার এমন কিছু আত্মীয়-স্বজন রয়েছে যাদের সাথে আমি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করি ; অথচ তারা আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। আমি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করি ; অথচ তারা আমার সাথে দুর্ব্যবহার করে। আমি তাদের সাথে ধৈর্যের পরিচয় দেই; অথচ তারা আমার সাথে কঠোরতা দেখায়। অতএব, তাদের সাথে এখন আমার করণীয় কি? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ

“তুমি যদি সত্যি কথাই বলে থাকো তা হলে তুমি যেন তাদেরকে উত্তপ্ত ছাই খাইয়ে দিচ্ছো। আর তুমি যতদিন পর্যন্ত তাদের সাথে এমন ব্যবহার করতে থাকবে ততদিন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাদের ওপর তোমার জন্য একজন সাহায্যকারী নিযুক্ত থাকবে”।

৫. আত্মীয়-স্বজনদের খুঁটিনাটি ভুলচুকের কৈফিয়তসমূহ মেনে নিবে। কারণ, মানুষ বলতেই তো ভুল হওয়া একান্তই স্বাভাবিক। এ ব্যাপারে ইউসুফ ‘আলাইহিস সালামের রেখে যাওয়া জ্বলন্ত আদর্শের কথা মাঝে মাঝে স্মরণ করা যেতে পারে। কেননা, তিনি এতো কিছুর পরও তাঁর ভাইয়েরা যখন তাদের কৃতকর্মের জন্য তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়েছে তখন তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। বরং তিনি তাদের ক্ষমার জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট একান্তভাবে ফরিয়াদও করেছেন।

৬. আত্মীয়-স্বজনরা নিজেদের ভুলের জন্য ক্ষমা না চাইলেও নিজের উদারতা বশত তাদেরকে ক্ষমা করে দিবে এবং তাদের দোষ-ত্রুটিসমূহ একেবারেই ভুলে যাবে।

কারণ, তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উন্নত মানসিকতা ও পরম সাহসিকতার পরিচয় বহন করে। বুদ্ধিমান ব্যক্তি তো সেই যে নিজ আত্মীয়-স্বজনকে ক্ষমা করে দেয় এবং তাদের দোষ-ত্রুটিগুলো একেবারেই ভুলে যায়।

৭. নিজ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে নম্রতা ও ভদ্রতার পরিচয় দিবে। কারণ, এতে করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনরা তাকে অধিক হারে ভালোবাসবে এবং তার নিকটবর্তী হওয়ার জন্য সর্বদা চেষ্টা করবে।

৮. আত্মীয়-স্বজনদের খুঁটিনাটি ভুলচুক সমূহ নিজ চোখে দেখেও তা না দেখার ভান করবে এবং তা নিয়ে কখনো ব্যস্ত হবে না। কারণ, এটি হলো মহান ব্যক্তিদের অনুপম চরিত্র। আর এভাবেই তো পরস্পরের ভালোবাসা দীর্ঘ দিন টিকে থাকে এবং পরস্পরের শত্রুতা ধীরে ধীরে লোপ পায়। আর এটি হচ্ছে উন্নত মানসিকতা ও স্বচ্ছতার পরিচায়ক। এতে করে মানুষের মান-সম্মান ক্রমেই বাড়তে থাকে। কখনো তা কমে না।

আল্লামা ইবন হিব্বান রহ. বলেন, যে ব্যক্তি মানুষের সাথে চলার ক্ষেত্রে তাদের দোষ-ত্রুটি সমূহ এড়িয়ে চলা এবং তাদের থেকে বেশি কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করার নীতি অবলম্বন করে না সে স্বচ্ছ জীবনের চাইতে অস্বচ্ছ জীবনই বেশি ভোগ করবে। মানুষের বন্ধুত্বের চাইতে তাদের শত্রুতাই তার ভাগ্যে বেশি জুটবে।[2]

৯. যথাসাধ্য আত্মীয়-স্বজনদের খিদমত করার চেষ্টা করবে। চাই তা সরাসরি হোক অথবা নিজের ধন-সম্পদ ও পদ-মর্যাদা দিয়েই হোক না কেন।

১০. আত্মীয়-স্বজনদেরকে কখনো নিজ অনুগ্রহের খোঁটা দিবে না। এমনকি তাদের থেকে সমপর্যায়ের আচরণের আশাও করবে না। কারণ, ইতোপূর্বেই বলা হয়েছে, সে ব্যক্তি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষাকারী হিসেবে গণ্য হবে না যে ব্যক্তি কেউ তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করলেই তবে সে তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে।

১১. আত্মীয়-স্বজনদের সাথে অল্পতে তুষ্ট থাকার নীতি অবলম্বন করবে। কারণ, এ নীতি অবলম্বন করলেই আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা অতি সহজতর হয়। নতুবা নয়।

১২. আত্মীয়-স্বজনদের অবস্থা ও মানসিকতা বুঝেই তাদের সাথে অনুরূপ আচরণ করবে। কারণ, আত্মীয়-স্বজনদের কেউ কেউ তো এমনো রয়েছে যে, তার সাথে বছরে অন্তত একবার সাক্ষাৎ এবং মাঝে মাঝে সামান্য ফোনালাপই যথেষ্ট। আবার কেউ কেউ তো এমনো রয়েছে যে, তার সাথে মাঝে মাঝে কিছু হাসিখুশি কথা বললেই সে তাতে খুব খুশি। আবার কেউ কেউ এমনো রয়েছে যে, তার সাথে বারবার সাক্ষাৎ দিতে হয় এবং সর্বদা তার খবরাখবর নিতে হয়। নতুবা সে রাগ করে। অতএব আত্মীয়দের প্রত্যেকের সাথে তার মেযাজ অনুযায়ী আচরণ করবে। তা হলেই তাদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা অতি সহজেই সম্ভবপর হবে।

১৩. আত্মীয়দের সাথে আপ্যায়নে বাড়াবাড়ি করবে না।

কারণ, আত্মীয়-স্বজনরা যখন দেখবে আপনি তাদের আপ্যায়নে বাড়াবাড়ি করছেন না তখন তারা বারবার আপনার সাথে সাক্ষাতে উৎসাহী হবে। আর যখন তারা দেখবে আপনি তাদের আপ্যায়নে বাড়াবাড়ি করছেন তখন তারা আপনার সাথে বারবার সাক্ষাতে সঙ্কোচ বোধ করবে এ মনে করে যে, তারা আপনার সাথে বারবার সাক্ষাৎ করে আপনাকে বিরক্ত করছে না তো?!

১৪. কোনো কারণে আত্মীয়-স্বজনদের কাউকে একান্ত তিরস্কার করতে হলে তা হালকাভাবে করবে। কারণ, সত্যিকারার্থে ভদ্র ব্যক্তি সে, যে মানুষের অধিকারগুলো পুরোপুরিভাবে আদায় করে এবং নিজের অধিকারগুলো প্রয়োজন বোধে ছেড়ে দেয়। যাতে করে আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে পাস্পরিক সম্প্রীতি বজায় থাকে। তবে নিজের অধিকার খর্ব হওয়ার দরুন কাউকে একান্ত তিরস্কার করতে হলেও তা হালকাভাবে করবে।

১৫. আত্মীয়-স্বজনদের তিরস্কার সহ্য করবে এবং তার একটি সুন্দর ব্যাখ্যাও বের করবে। এটি হচ্ছে সত্যিকারার্থে বিশিষ্ট গুণীজনদেরই চরিত্র। যাঁদের মধ্যে মানবিক যাবতীয় গুণাবলী বিদ্যমান এবং যারা শীর্ষ স্থানীয় চরিত্রবান তারাই তো সমাজের অত্যন্ত ধৈর্যশীল ব্যক্তিবর্গই হয়ে থাকেন। তাদের কোনো আত্মীয়-স্বজন তাদেরকে তিরস্কার করলে তারা মনে করেন, তাঁদের উক্ত আত্মীয় সত্যিই তাঁদেরকে অত্যধিক ভালোবাসেন এবং তাদের বারবার আসা-যাওয়া ও সাক্ষাৎ তিনি অবশ্যই কামনা করেন। তাই তারা তাঁদের উক্ত আত্মীয়ের নিকট তাঁদের কৃত অপরাধ স্বীকার করেন। কারণ, দুনিয়াতে কিছু লোক তো এমনো রয়েছে যে, তারা অন্যদেরকে খুবই ভালোবাসেন ঠিকই। তবে তারা অন্যের কোনো দোষ-ত্রুটি দেখলেই তাকে খুবই তিরস্কার করে।

১৬. আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যে কোনো ধরণের হাসি-ঠাট্টা করতে তাদের সার্বিক অবস্থার প্রতি খেয়াল রাখবে এবং তাদের মধ্যে যারা হাসি-ঠাট্টা মোটেই পছন্দ করে না তাদের সাথে তা করবে না।

১৭. আত্মীয়-স্বজনদের সাথে কোনোভাবেই বাগ্বিতণ্ডা ও তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়বে না। কারণ, তা ধীরে ধীরে পরস্পরের মাঝে বিদ্বেষ ও শত্রুতা সৃষ্টি করে। বরং তাদের সাথে এমন সকল আচরণ করা থেকে দূরে থাকবে যা সাধারণত পারস্পরিক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে।

১৮. কখনো নিজ আত্মীয়-স্বজনদের কারোর সাথে কোনো ধরণের ঝগড়া-বিবাদ ঘটে গেলে যথাসাধ্য আকর্ষণীয় উপঢৌকনের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যকার পূর্বের ভাব ও সম্পর্ক ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে। কারণ, হাদিয়া ও উপঢৌকন এমন একটি জিনিস যা পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করে এবং পরস্পরের মধ্যকার ভুল ধারণাসমূহ নিরসন করে।

১৯. সর্বদা এ কথা মনে রাখবে যে, আত্মীয়-স্বজনরা হচ্ছে নিজের শরীরের একটি অংশের ন্যায়।

সুতরাং তাদেরকে পরিত্যাগ করা কখনোই সম্ভবপর নয়। বরং তাদের সম্মানই নিজের সম্মান এবং তাদের অসম্মানই নিজের অসম্মান। আরবরা বলে থাকে, “নাক তো তোমারই যদিও তা থেকে লাগাতার সিন বের হয়”।

২০. সর্বদা এ কথা মনে রাখবে যে, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা সত্যিই একটি নিকৃষ্ট কাজ।

কেউ এতে নিজকে লাভবান মনে করলেও মূলতঃ সে ক্ষতিগ্রস্ত এবং কেউ এতে নিজকে বিজয়ী মনে করলেও মূলতঃ সে পরাজয়ী।

২১. বিয়ে-শাদী, আক্বীকা ইত্যাদি তথা যে কোনো অনুষ্ঠানে আত্মীয়-স্বজনদেরকে দাওয়াত দেওয়ার প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখবে। এ জন্য সহজ উপায় হচ্ছে, প্রত্যেকেই নিজের সকল আত্মীয়-স্বজনদের একটি লিস্ট সংরক্ষণ করবে। যাতে থাকবে তাদের নাম ও টেলিফোন কিংবা মোবাইল নম্বর। আর যখনই কোনো অনুষ্ঠান করার চিন্তা করবে তখনই উক্ত লিস্ট খুলে সবাইকে যথাসাধ্য দাওয়াত দেয়ার চেষ্টা করবে। চাই তা সরাসরি হোক অথবা টেলিফোনের মাধ্যমে। যদি কোনো আত্মীয় যে কোনোভাবে উক্ত দাওয়াত থেকে বাদ পড়ে যায় তা হলে অতি দ্রুত নিজের ভুল স্বীকার করে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবে এবং তাকে যে কোনোভাবে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করবে।

২২. আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে কোনো ধরনের সমস্যা ঘটে গেলে তাদের মধ্যে যাকে আল্লাহ তা‘আলা সবার ভালোবাসা কুড়ানোর সুযোগ দিয়েছেন তাকে উক্ত সমস্যা দূর করার জন্য দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে। তা না করলে একদা উক্ত সমস্যা বড়ো থেকে বড়ো হয়ে সবাইকেই জড়িয়ে ফেলবে।

২৩. নিজেদের মধ্যকার কেউ মারা গেলে তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি দ্রুত ওয়ারিশদের মাঝে বন্টন করে দিবে।

যেন কারোর ওয়ারিশি সম্পত্তি নিয়ে ওয়ারিশ আত্মীয়-স্বজনদের পরস্পরের মাঝে দ্বন্দ্ব-বিগ্রহ সৃষ্টি না হয়।

২৪. আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যকার যৌথ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সবাই নিজেদের মধ্যে সর্বদা একতা ও সমঝোতার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিবে। আমানতদারিতা, সত্যবাদিতা, পরস্পর দয়া, ভালোবাসা ও পরামর্শ এবং অন্যকে নিজের উপর অগ্রাধিকার দেয়ার প্রতি সর্বদা যত্নবান থাকবে। প্রত্যেকে অন্যের জন্য তাই ভালোবাসবে যা নিজের জন্য ভালোবাসে এবং প্রত্যেকে নিজের অধিকারের পাশাপাশি অন্যের অধিকারের প্রতিও যত্নবান হবে।

কখনো কোনো সমস্যা অনুভূত হলে তা অত্যধিক সুস্পষ্টতার সাথে বিশেষ পর্যালোচনার মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করবে। প্রত্যেকেই নিষ্ঠার সাথে কাজ করার চেষ্টা করবে। অন্যের কাজের প্রতি বেশি দৃষ্টি দিবে না। যে কোনো ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত হলে তা লিখে রাখার চেষ্টা করবে। এভাবে চলতে থাকলে ইন্শাআল্লাহ তাদের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে রহমত ও বরকত নাযিল হবে এবং নিজেদের মধ্যকার ভালোবাসা দীর্ঘ দিন অটুট থাকবে।

২৫. মাসে, ছয় মাসে অথবা বছরে অন্তত একবার হলেও আত্মীয়-স্বজনরা সবাই কোথাও না কোথাও একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করবে। এভাবে সবাই একত্রিত হলে পরস্পর পরিচিতি, সহযোগিতা ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে উক্ত বৈঠকগুলোর নেতৃতে যদি থাকে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানরা।

২৬. আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য নিজেদের মধ্যে সর্বদা একটি ফান্ড রাখা উচিত। তাতে সবার পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট হারে মাসিক চাঁদা, নিজেদের মধ্যকার ধনীদের বিশেষ দান-সাদাকা সংগ্রহ করা যেতে পারে। আত্মীয়-স্বজনদের কেউ কোনো সমস্যায় পড়লে তা বিশেষভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সে ব্যাপারে তাকে যথাযোগ্য সহযোগিতা করবে। এতে করে পরস্পরের মাঝে ভালোবাসা জন্মিবে ও বৃদ্ধি পাবে।

২৭. আত্মীয়-স্বজনদের একটি ফোন বুক তৈরি করে তা কপি করে সবার মাঝে বিতরণ করবে। উক্ত ফোন বুকটি সর্বদা নিজ আত্মীয়-স্বজনকে স্মরণ করিয়ে দিবে। এতে করে ফোনের মাধ্যমে আত্মীয়-স্বজনদের খবরাখবর নেওয়া এবং তাদেরকে বিশেষ অনুষ্ঠানাদিতে দাওয়াত দেয়া সহজ হবে। আত্মীয়তার বন্ধনও রক্ষা পাবে।

২৮. আত্মীয়-স্বজনদের যে কাউকে বার বার বিরক্ত করা ও ঝামেলায় ফেলা থেকে বিরত থাকবে। কাউকে তার সাধ্যাতীত কিছু করতে বার বার বিরক্ত করবে না। বিশেষ করে আত্মীয়-স্বজনদের কেউ যদি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা বা ধনী ব্যক্তি হোন তা হলে তাদেরকে এমন কাজ করতে চাপ সৃষ্টি করবে না যা তাদের সাধ্যের বাইরে অথবা কষ্টসাধ্য। যদি তারা কোনো কারণে কারোর কোনো আবদার রক্ষা করতে না পারে তা হলে তাঁদেরকে কোনো তিরস্কার করবে না। বরং তাদেরকে এ ক্ষেত্রে অপারগ মনে করবে।

২৯. আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে পারস্পরিক পরামর্শ আদান-প্রদানের সুব্যবস্থা থাকা উচিত। বরং তাদের মাঝে একটি স্থায়ী মজলিসে শুরা থাকলে তা আরো ভালো। যাতে করে কারোর কোনো বড়ো সমস্যা দেখা দিলে তাদের উপযুক্ত পরামর্শ নেয়া যায় এবং এমন এক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যাতে আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট থাকবেন। উপরন্তু আত্মীয়-স্বজনরাও সবাই খুশি থাকবে। তবে মজলিসে শুরার সদস্যরা এমন হতে হবে যাদের রয়েছে অত্যধিক দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, ধৈর্য ও যথা সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার দুর্বার ক্ষমতা।

৩০. তবে উপরোক্ত সকল বিষয়ে এ কথার খেয়াল রাখবে যে, যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক হয় একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য এবং পারস্পরিক সহযোগিতা হয় পরোকল্যাণ ও আল্লাহভীরুতা র ভিত্তিতে। যেন তা জাহেলী যুগের বংশ ও আত্মীয় প্রেমের ভিত্তিতে না হয়।

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার ফযীলত :

১. আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানের পরিচায়ক : আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ঈমানের পরিচায়ক। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে’।

২. আল্লাহর আনুগত্যের প্রকাশ : আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা আল্লাহর আনুগত্য করার বহিঃপ্রকাশ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আদেশ করেছেন যারা তা অক্ষুণ্ণ রাখে, ভয় করে তাদের প্রতিপালককে এবং ভয় করে কঠোর হিসাবকে’ (রা‘দ ১৩/২১)

৩. আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম :  আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার মাধ্যমে মহান আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,‘রেহেম’ (রক্তের বাঁধন) ‘রহমানের’ অংশ বিশেষ। সে বলবে, ‘হে প্রভু! আমি মাযলূম, আমি ছিন্নকৃত। হে প্রভু! আমার সাথে দুর্ব্যবহার করা হয়। হে প্রভু! হে প্রভু! তখন তার প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলা জবাব দিবেন, তুমি কি সন্তুষ্ট নও যে, যে ব্যক্তি তোমাকে ছিন্ন করবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব এবং যে তোমাকে যুক্ত করবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক জুড়ে রাখব’?

৪. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অছিয়ত প্রতিপালন করা : নবী করীম (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে স্বীয় উম্মতকে বিভিন্ন বিষয়ে অছিয়ত করেছেন। তন্মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা অন্যতম। সুতরাং আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখা হ’লে তাঁর উপদেশ প্রতিপালন করা হবে। এ মর্মে হাদীছে এসেছে, আবু যর গিফারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমার বন্ধু নবী করীম (ছাঃ) আমাকে কতিপয় উত্তম গুণের ব্যাপারে উপদেশ দেন। তিনি আমাকে উপদেশ দেন যে, আমি যেন আমার চেয়ে উঁচু স্তরের লোকের দিকে লক্ষ্য না করি; বরং আমার চেয়ে নিম্নস্তরের লোকের দিকে তাকাই। তিনি আরো উপদেশ দেন, দরিদ্রদের ভালবাসতে ও তাদের নিকটবর্তী হ’তে। তিনি উপদেশ দেন আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে, যদিও তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে…’।

৫. আল্লাহর নিকট অন্যতম প্রিয় আমল :

মানুষের কৃত অনেক আমল আল্লাহর নিকটে প্রিয় ও পসন্দনীয়। তন্মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা অন্যতম। এ মর্মে হাদীছে এসেছে, ‘খাছ‘আম গোত্রের জনৈক লোক হ’তে বর্ণিত সে বলল, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর দরবারে আসলাম। তিনি তখন ছাহাবীদের একটি ক্ষুদ্র দলের সাথে ছিলেন। আমি বললাম, আপনিতো সেই ব্যক্তি যিনি ধারণা করেন যে, আপনি আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, হ্যাঁ। রাবী বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কোন আমল আল্লাহর নিকটে পসনদনীয়? তিনি বললেন, আল্লাহর উপরে ঈমান আনা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এরপর কি? তিনি বললেন, আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এরপর কি? তিনি বললেন, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কোন আমল আল্লাহর নিকটে অপসন্দনীয়? তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এরপর কি? তিনি বললেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এরপর কি? তিনি বললেন, গর্হিত কাজের নির্দেশ দেওয়া এবং সৎকাজে নিষেধ করা’।[4]

৬. বয়স ও রিযিক বৃদ্ধির উপায় : আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে মানুষের বয়স ও জীবিকা বৃদ্ধি পায়।

৭. আত্মীয়দের মাঝে পারস্পরিক মুহাববত বৃদ্ধির মাধ্যম : আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে ভালবাসার বন্ধন সুদৃঢ় হয়। হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালককে ভয় করে এবং তার আত্মীয়-স্বজনকে জুড়ে রাখে, তার মৃত্যু পিছিয়ে দেওয়া হয়, তার সম্পদ বৃদ্ধি করা হয় এবং তার পরিবার-পরিজন তাকে ভালবাসে’।

৮. পৃথিবীর অধিবাসীদের উন্নয়ন : আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা পৃথিবীবাসীদের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে এবং তাদের বয়স বৃদ্ধি করে। এ মর্মে হাদীছে এসেছে, আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) তাকে বলেছেন, ‘যাকে নম্রতা দান করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখিরাতের বহু কল্যাণ দেওয়া হয়েছে। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা, উত্তম চরিত্র ও সৎ প্রতিবেশী দুনিয়ার অধিবাসীদের উন্নয়ন ঘটায় এবং বয়স বৃদ্ধি করে’।

৯. দ্রুত ছওয়াব লাভের উপায় : আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখলে অবিলম্বে ছওয়াব বা প্রতিদান লাভ করা যায়। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,‘আল্লাহর আনুগত্যে সম্পন্ন এমন কোন কাজ নেই, যার মাধ্যমে দ্রুত ছওয়াব লাভ করা যায় আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ব্যতীত। আর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা ও বিদ্রোহ করা ব্যতীত কোন কাজে দ্রুত শাস্তি আপতিত হয় না’।

১০. আত্মীয়তার সম্পর্ক ক্বিয়ামতের দিন সাক্ষী দিবে :

যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করবে ক্বিয়ামতের দিন অপরাপর আত্মীয়-স্বজন তার পক্ষে সাক্ষ্য দিবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, রক্তের বন্ধন ক্বিয়ামতের দিন তার সংশ্লিষ্টজনের সম্মুখে এসে দাঁড়াবে এবং যদি সে তাকে দুনিয়ায় যুক্ত রেখে থাকে, তবে সে তার পক্ষে সাক্ষ্য দিবে, যদি সে তাকে দুনিয়ায় ছিন্ন করে থাকে, তবে সে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে’।

১১. জান্নাতে প্রবেশের উত্তম মাধ্যম : আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে জান্নাতে প্রবেশ করা সহজ হয়।

আত্মীয়তার সম্পর্ক বৃদ্ধির কতিপয় উপায় :

১. আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত হওয়া :

কোন জিনিসের ফলাফল ও শুভ পরিণতি অবগত হ’লে সে কাজ সম্পাদনে মানুষ উৎসাহী ও আগ্রহী হয় এবং তা সম্পাদনে সচেষ্ট ও যথাসাধ্য তৎপর হয়। তাই আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব ও ফযীলত অবগত হওয়া আবশ্যক।

২. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার পরিণতি জানা :

আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার পাপ ও পরিণতি অবগত হ’লে মানুষ এসব থেকে সাবধান হবে। তাছাড়া এ কারণে যে পার্থিব অনিষ্ট রয়েছে তা জানলে এ বন্ধন সংরক্ষণে সচেষ্ট হবে।

৩. আল্লাহর নিকটে সাহায্য প্রার্থনা :

আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা নেকীর কাজ। তাই এ কাজ করার জন্য আল্লাহর কাছে তাওফীক কামনা করতে হবে। পক্ষান্তরে এ সম্পর্ক ছিন্ন করা পাপ। তাই এ পাপ থেকে বেঁচে থাকার জন্যও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে।

৪. আত্মীয়-স্বজনের দুর্ব্যবহার সুন্দরভাবে মোকাবিলা করা :

জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর মাঝে মুহাববত বজায় রাখা, তাদের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা এবং অসদাচরণেও ধৈর্য ধারণ করা ও তা সুন্দরভাবে মোকাবিলা করা। যেমন হাদীছে এসেছে, একদা এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ছাঃ)! আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন রয়েছে, আমি তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করি, কিন্তু তারা আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। আমি তাদের প্রতি অনুগ্রহ করি কিন্তু তারা আমার সাথে অসদাচরণ করে। তারা আমার সাথে গোয়ার্তুমি করে। আমি সহ্য করি। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘যদি তোমার বক্তব্য ঠিক হয়, তবে তো তুমি যেন তাদের মুখে উত্তপ্ত ছাই পুরে দিচ্ছ। তোমার কারণে তাদের দুর্ভোগ আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি এরূপ করতে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ হ’তে একজন সাহায্যকারী তাদের মুকাবিলায় তোমার সাথে থাকবেন’।

৫. ভুলের পর তাদের পেশকৃত কৈফিয়ত গ্রহণ করা : আত্মীয়-স্বজন ভুল করার পর কৈফিয়ত পেশ করলে তাদের সে কৈফিয়ত গ্রহণ করা এবং তাদের ক্ষমা করে দেওয়া। যেমন ইউসুফ (আঃ) স্বীয় ভাইদের পেশকৃত কৈফিয়ত গ্রহণ করেন এবং তাদের ক্ষমা করে দেন (ইউসুফ ১২/৯১-৯২)

৬. তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া : মানুষ মাত্রই ভুল করে, অপরাধ করে। সুতরাং আত্মীয়-স্বজনের কৃত অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া উদার চিত্ত ও ভদ্র-শালীন মানুষের পরিচয়। তাদের এ অপরাধ ভুলে যাওয়া এবং পরবর্তীতে কখনো এসব তাদের সামনে উচ্চারণ না করা। এতে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটবে।

৭. তাদের সাথে বিনয়ী ও নম্র আচরণ করা : আত্মীয়দের সাথে নম্র-ভদ্র আচরণ করলে সর্ম্পক মযবূত হয়। সম্পর্কের সেতুবন্ধন অক্ষুণ্ণ থাকে। আত্মীয়-স্বজন আরো নিকটতর হয়। তাই আত্মীয়দের ভুল-ত্রুটি আমলে না নিয়ে তা উপেক্ষা করার চেষ্টা করতে হবে।

৮. তাদের ভুল-ত্রুটি উপেক্ষা করা : মানুষের ভুল-ত্রুটি উপেক্ষা করা মহত্ত্বের পরিচয়। বিশাল হৃদয়ের মানুষের পক্ষেই এটা সম্ভব। এর মাধ্যমে হৃদ্যতা বৃদ্ধি পায়, বৈরিতা দূরীভূত হয়।

৯. তাদের জন্য সাধ্যমত ব্যয় করা :

আত্মীয়দের জন্য সাধ্যমত ব্যয় করা। কেননা তাদের জন্য দান করলে অধিক ছওয়াব পাওয়া যায় এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা হয়। যেমন আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘মদীনার আনছারগণের মধ্যে আবূ তালহা (রাঃ) সর্বাধিক খেজুর বাগানের মালিক ছিলেন। মসজিদে নববীর নিকটবর্তী বায়রুহা নামক বাগানটি তার কাছে অধিক প্রিয় ছিল। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তার বাগানে প্রবেশ করে এর সুপেয় পানি পান করতেন। আনাস (রাঃ) বলেন, যখন এ আয়াত অবতীর্ণ হ’ল, ‘তোমরা যা ভালবাস তা হ’তে ব্যয় না করা পর্যন্ত তোমরা কখনো পুণ্য লাভ করবে না’ (আলে ইমরান ৯২)। তখন আবু তালহা (রাঃ) আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে গিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা যা ভালবাস তা হ’তে ব্যয় না করা পর্যন্ত কখনো পুণ্য লাভ করবে না’ (আলে ইমরান ৯২)। আর বায়রুহা বাগানটি আমার কাছে অধিক প্রিয়। এটি আল্লাহর নামে ছাদাক্বাহ করা হ’ল, আমি এর কল্যাণ কামনা করি এবং তা আল্লাহর নিকট আমার জন্য সঞ্চয়রূপে থাকবে। কাজেই আপনি যাকে দান করা ভাল মনে করেন তাকে দান করুন। তখন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তোমাকে ধন্যবাদ, এ হচ্ছে লাভজনক সম্পদ, এ হচ্ছে লাভজনক সম্পদ। তুমি যা বলেছ, তা শুনলাম। আমি মনে করি, তোমার আপনজনদের মধ্যে তা বণ্টন করে দাও’। আবু তালহা (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি তাই করব। অতঃপর তিনি তার আত্মীয়-স্বজন, আপন চাচার বংশধরের মধ্যে তা বণ্টন করে দিলেন’।

১০. খোঁটাদান পরিহার ও তাদের নিকট দাবী-দাওয়া থেকে বিরত থাকা :

দান করে খোঁটা দেওয়া পাপ এবং এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنَّانٌ ‘খোঁটাদানকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[22] বিধায় আত্মীয়-স্বজনকে দান করে খোঁটা দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তেমনি তাদের নিকট থেকে কোন কিছু চাওয়া বা তাদের নিকটে কোন কিছু দাবী করা থেকেও বিরত থাকতে হবে।

১১. স্বজনদের অল্প উপঢৌকনেও তুষ্ট থাকা : উপহার-উপঢৌকন দিলে পারস্পরিক মুহাববত বৃদ্ধি পায়। মানুষের সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় না ঘটলে, পরস্পরকে উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত বস্ত্ত উপহার প্রদান করতে পারে না। তাই আত্মীয়দের প্রদত্ত উপহারে সন্তুষ্ট হওয়া প্রয়োজন, যদিও তা পরিমাণে কম হয়।

১২. তাদের অবস্থা ও অবস্থানের প্রতি লক্ষ্য রাখা : মাঝে-মধ্যে আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর রাখা, বছরে একবার হ’লেও তাদের সাথে সাক্ষাৎ করা প্রত্যেকের কর্তব্য। সেটা সম্ভব না হ’লে অন্তত টেলিফোন বা মোবাইলে খোঁজ-খবর নেওয়া এবং তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা যরূরী। তাদের সাথে হাসিমুখে কথা বলা এবং যথাসাধ্য সুসম্পর্ক বজায় রাখা। তাদের অধিকার পরিপূর্ণভাবে আদায় করা। এছাড়া তাদের মর্যাদা ও স্তর অনুযায়ী যথোপযুক্ত সম্মান করা। এতে করে আত্মীয়তার বন্ধন অটুট থাকবে এবং পরস্পরের মধ্যে হৃদ্যতা বৃদ্ধি পাবে।

১৩. তাদের কষ্ট না দেওয়া ও তাদের সমস্যা দূর করা : কোন আত্মীয়কে কখনও কষ্ট না দেওয়া এবং তাদের সমস্যাবলী যথাসাধ্য দূর করার চেষ্টা করা। আত্মীয়-স্বজন যখন জানবে যে, অমুক ব্যক্তি আত্মীয়দের সাথে উত্তম ব্যবহার করে, সে কাউকে কষ্ট দেয় না এবং তাদের অসুবিধা দূর করতে সচেষ্ট ও তাদের সমস্যায় সহযোগিতা করে, তখন তার সাথে সকলে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে; তার প্রতিও সকলে সহমর্মী ও সহযোগী হবে।

১৪. তাদের ভৎর্সনা ও তিরস্কার করা থেকে বিরত থাকা : আত্মীয়-স্বজন বাড়ীতে আসলে আনন্দিত হওয়া এবং তাদের সমাদর করা। কখনও কোন কাজে ত্রুটি হ’লে তাদের ভৎর্সনা ও তিরস্কার না করা। শালীন ব্যক্তি মাত্রই মানুষের যথোপযুক্ত হক প্রদান করে থাকেন। তিনি নিজের হকের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করেন না; অপরে তার অধিকার আদায় করুক বা না করুক সেদিকেও লক্ষ্য রাখেন না; বরং অপরের হক আদায়ে তৎপর থাকেন। তেমনি কোন আত্মীয় কারো যথাযথ হক আদায় না করলেও তাকে তিরস্কার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

১৫. আত্মীয়দের সমালোচনা সহ্য করা : বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের অন্যতম গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের সাথে অতি জঘন্য, যন্ত্রণা ও পীড়াদায়ক আচরণ করা হ’লেও তাঁরা সেসব অম্লান বদনে সহ্য করেন এবং তাদের সাথে খারাপ আচরণ করেন না, বরং উত্তম ব্যবহার করেন। সুতরাং আত্মীয়দের সাথেও অনুরূপ আচরণ করতে হবে। কখনও তারা সমালোচনা করলেও তা সহ্য করতে হবে। এতে তারা আরো নিকটতর হবে।

১৬. আত্মীয়দের সাথে হাসি-ঠাট্টায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করা : সমাজের সকল মানুষ সব জিনিস পসন্দ করে না। যেমন অনেকে হাসি-ঠাট্টা পসন্দ করেন না। আত্মীয়দের মাঝেও অনুরূপ মানুষ থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই তাদের মন মেজায বুঝে হাসি-মশকরা করতে হবে এবং এতেও মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে। যাতে এসব তুচ্ছ কারণে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন না হয়।

১৭. ঝগড়া-বিবাদের পথ পরিহার করা : মানুষ হিসাবে পরস্পর মনোমালিন্য সৃষ্টি হ’তে পারে। আর এটা কখনো ঝগড়া-বিবাদে রূপ নেয়। কিন্তু আত্মীয়দের মাঝে যাতে এরূপ না ঘটে তার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। কেননা এর মাধ্যমে শত্রুতা সৃষ্টি হয়, অন্তরে প্রতিশোধ পরায়ণতা জেগে ওঠে। কাজেই ঝগড়া-বিবাদের পথ সর্বোতভাবে পরিহার করতে হবে।

১৮. পরস্পর উপঢৌকন বিনিময় করা : উপহার-উপঢৌকন মুহাববত বৃদ্ধি করে, খারাপ ধারণা দূরীভূত করে এবং আন্তরিক বিদ্বেষকে প্রতিহত করে। তাই আত্মীয়দের মাঝে পরস্পর হাদিয়া বিনিময় করা আবশ্যক। রাসূল (ছাঃ) বলেন, تَهَادُّوْا تَحَابُّوْا ‘তোমরা পরস্পরকে হাদিয়া দাও, একে অপরের মধ্যে হৃদ্যতা বৃদ্ধি কর’।

১৯. আত্মীয়কে চোখের মণি ভাবা : আত্মীয়-স্বজনকে নিজের দেহের অংশ হিসাবে জ্ঞান করে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চিন্তা মনে না আনা। বরং তাদের সম্মান-মর্যাদাকে নিজের সম্মান এবং তাদের অপমানকে নিজের লাঞ্ছনা মনে করা। আত্মীয়দের প্রতি কারো এরূপ মনোভাব থাকলে এ বন্ধন আরো সুদৃঢ় হবে।

২০. আত্মীয়দের সাথে বৈরিতা অনিষ্ট ও বিপদের কারণ :

আত্মীয়-স্বজনের সাথে শত্রুতা ও বৈরী মনোভাব না থাকা। এতে অকল্যাণ ও বিপদের পথ প্রশস্ত হয়। কেননা মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। নিজের জীবন চলার পথে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা তার প্রয়োজন হয়। এ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে আত্মীয়রা সর্বাগ্রে এগিয়ে আসে। আর আত্মীয়দের সাথে বৈরিতা থাকলে তারা বিপদ-মুছীবতের সময়ও দূরে থাকে। ফলে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি আরো অকল্যাণ ও বিপদের সম্মুখীন হয়। এজন্য আত্মীয়দের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।

২১. যথাসময়ে আত্মীয়দের স্মরণ করতে আগ্রহী হওয়া : যথাসময়ে আত্মীয়দের স্মরণ করার অর্থ হচ্ছে বিবাহ-শাদী, ওয়ালীমা বা এ ধরনের অনুষ্ঠান ও সমাবেশে তাদেরকে দাওয়াত দেওয়া এবং তাদের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ভুলবশত কেউ বাদ পড়ে গেলে তার কাছে গিয়ে কৈফিয়ত পেশ করে, সাধ্যমত তাকে রাযী-খুশি করা। এতে সম্পর্ক আরো বৃদ্ধি পাবে।

২২. আত্মীয়দের মাঝে বিবাদ মীমাংসায় উৎসাহী হওয়া : আত্মীয়দের পরস্পরের মাঝে বিবাদ মীমাংসার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা। কেননা আত্মীয়দের মাঝের ঝগড়া-বিবাদ ও ফিৎনা-ফাসাদ মিটিয়ে না ফেললে এটা বাড়তে থাকে। যা এক সময় অন্যান্য আত্মীয়দের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এই বিবাদের অগ্নি সকলকে জ্বালিয়ে মারে। পক্ষান্তরে বিবাদ মিটিয়ে ফেললে সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়।

২৩. পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টনে দ্রুততা : কোন স্বজনের রেখে যাওয়া সম্পদ উত্তরাধিকারীদের মাঝে দ্রুত বণ্টনের ব্যবস্থা করা। সেই সাথে বণ্টনে ন্যায়-ইনছাফ বজায় রাখা, যাতে প্রত্যেক প্রাপক তার যথাযথ অংশ পায়। আর পরিত্যক্ত সম্পদ নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির পূর্বেই এ কাজ সম্পন্ন করা শ্রেয়। এতে আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে সম্পর্ক কালিমামুক্ত ও নিষ্কলুষ হয়।

২৪. যৌথ অনুষ্ঠানে ঐক্যমতের প্রতি আগ্রহী হওয়া : কোন যৌথ অনুষ্ঠানে সকল ক্ষেত্রে সবার সাথে ঐক্যমত পোষণ করার প্রতি আগ্রহী হওয়া। নিজের মত প্রতিষ্ঠা বা নিজের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অটল থাকার মন-মানসিকতা পরিহার করা। তাদের মধ্যে হৃদ্যতা বৃদ্ধি, পরামর্শ প্রদান, সকলের প্রতি অনুগ্রহ করা এবং সততা ও আমানত রক্ষা করা। আর প্রত্যেকেই নিজের জন্য যা পসন্দ করবে অন্যের জন্যও তাই পসন্দ করবে। তদ্রূপ প্রত্যেককেই নিজের ও অপরের হক সম্পর্কে অবগত হওয়া। তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করা এবং সমস্যা সমাধানের জন্য বিস্তারিত ও খোলামেলা আলোচনা করা। তাদের সাথে ঘনিষ্ট আচরণ করা এবং অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ থেকে সর্বোতভাবে বিরত থাকা। কখনও তাদেরকে উপেক্ষা না করা। কেউ কোন ব্যাপারে একমত না হ’লেও তার সাথে ভাল ব্যবহার করা। এভাবে চলতে পারলে তাদের মধ্যে রহমত অবধারিত হবে, হৃদ্যতা বৃদ্ধি পাবে এবং তাদের মধ্যে বরকত নাযিল হবে।

২৫. আত্মীয়তার প্রমাণ সংরক্ষণ : আত্মীয়তার প্রমাণ সংরক্ষণ দু’ভাবে করা যায়। (ক) কাগজে আত্মীয়দের নাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বর লিখে সংরক্ষণ করা এবং সকলকে কপি দেওয়া। বংশীয় সম্পর্ক বা আত্মীয়তার সম্পর্ক লিখে বা মুখস্থ করে সংরক্ষণের ব্যাপারে হাদীছে নির্দেশ এসেছে। যেমন জুবায়র ইবনু মুতঈম (রাঃ) বলেন, তিনি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-কে মিম্বরের উপর ভাষণরত অবস্থায় বলতে শুনেছেন, অর্থাৎ তোমাদের বংশপঞ্জিকা (নসবনামা) জেনে রাখ এবং (তদনুযায়ী) ঘনিষ্ঠজনদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা কর। আল্লাহর কসম! অনেক সময় কোন ব্যক্তি ও তার (বংশানুক্রমিক) ভাইয়ের মধ্যে (অপ্রীতিকর) কিছু একটা ঘটে যায়; যদি সে জানতে পারত যে, তার এবং এর মধ্যে রক্তের বন্ধন বিদ্যমান রয়েছে, তবে তারা তাকে তার ভাইকে অপদস্থ করা হ’তে নিবৃত্ত করত।

(খ) আত্মীয়দের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার সময় সন্তান-সন্ততিকে সঙ্গে নেওয়া। যাতে তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় তারা অভ্যস্ত হয় এবং তাদের সাথে পরিচিত হয়।

২৬. আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করাকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম মনে করা : সর্বোপরি সকল ক্ষেত্রে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর রাযী-খুশির উদ্দেশ্যে কাজ করতে হবে, এতে অন্য কাউকে শরীক করা চলবে না। সকল কাজ হবে নেকী ও তাক্বওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা, জাহিলী কোন বিষয়ের সংরক্ষণ ও উন্নয়ন লক্ষ্য হবে না। তেমনি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকে ছওয়াব অর্জন ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করলে এ সম্পর্কে কখনও চিড় ধরবে না।

সংগৃহীত

Views: 100