সালাম অর্থ শান্তি। সালাম শান্তির প্রতীক, যা মানুষকে শান্তির বার্তা দেয়। শত্রুকে বন্ধু বানায়। দূরের মানুষকে আপন করে। দূরত্ব কমিয়ে ঘনিষ্ঠ করে। কোরআন ও হাদিসে সালামের অনেক গুরুত্ব ও ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন,

‘হে মোমিনগণ, তোমরা নিজেদের ঘর ছাড়া অন্য কারও ঘরে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না তোমরা অনুমতি নেবে এবং ঘরের লোকদের সালাম দেবে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।’ (সুরা নুর : ২৭)।

‘তোমরা যখন কোনো ঘরে প্রবেশ করবে, তখন নিজেদের ওপর সালাম করবে আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকতপূর্ণ ও পবিত্র অভিবাদনস্বরূপ।’ (সুরা নুর : ৬১)।

‘যখন তোমাদের সালাম দেয়া হবে, তখন তোমরা তার চেয়ে উত্তম সালাম দেবে অথবা জবাবে তা-ই বলবে।’ (সুরা নিসা : ৮৬)।

ইসলামের সর্বোত্তম আমল

এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে প্রশ্ন করল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! ইসলামে কোন আমলটি সর্বোত্তম?’ উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, ‘মানুষকে খাবার খাওয়ানো এবং তুমি যাকে চেন আর যাকে চেন না, সবাইকে সালাম দেয়া।’ (বোখারি ও মুসলিম)। তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না তোমরা পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে। আর ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা পরিপূর্ণ ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা একে অপরকে ভালোবাসবে না। আমি কী তোমাদের এমন একটি জিনিস বাতলে দেব, যা করলে তোমরা পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসবে?’ তারপর তিনি বললেন, ‘তোমরা বেশি বেশি সালামের প্রসার কর।’ (মুসলিম)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি সালাম দিতে কার্পণ্য করে, সে কৃপণ বলে গণ্য হবে।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যে ব্যক্তি প্রথমে সালাম দেয়, সে অহঙ্কারমুক্ত।’ (মুসলিম)।

সালামের প্রচলন যেভাবে

মানবসৃষ্টির সূচনা থেকেই সালামের প্রচলন হয়েছে। আল্লাহতায়ালা যখন আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেন, তখন থেকেই সালামের প্রচলন শুরু হয়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা আদম (আ.)-কে যখন সৃষ্টি করলেন, তখন বললেন- ‘যাও, অবস্থানরত ফেরেশতাদের দলকে সালাম কর। তারা তোমার সালামের উত্তরে কী বলে, তা শ্রবণ কর। তা-ই হবে তোমার এবং তোমার সন্তানদের সালামের পদ্ধতি।’ তখন আদম (আ.) বললেন, ‘আস সালামু আলাইকুম।’ জবাবে ফেরেশতারা বললেন, ‘আস সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।’ রাসুল (সা.) বলেন, তারা ‘ওয়া রহমাতুল্লাহ’ অংশটি বাড়িয়ে বলেছেন। (বোখারি : ৩৩২৬, মিশকাতুল মাসাবিহ : ৪৬২৮)।

ইসলামে যখন সালামের শুরু

আবু যর গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি মহানবী (সা.)-এর দরবারে হাজির হলে তিনি আমাকে ‘আস সালামু আলাইকুম’ বলে অভিবাদন জানালেন। তখন উত্তরে বললাম, ‘ওয়া আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।’ অতঃপর আবু যর গিফারি (রা.) বলেন, ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম যাকে সালাম দেয়া হয়, আমিই সেই ব্যক্তি। (ফাতহুল বারি : ১১/৪)।

সালাম কাকে দেবেন

সালাম সবাই একে অপরকে দেবে। ছোটরা বড়কে সালাম দেবে। আবার বড়রাও শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ছোটদের সালাম দেবে। ছাত্র ও মুরিদ উস্তাদ ও পীরকে সালাম দেবে। আগন্তুক ব্যক্তি মজলিসের সবাইকে সালাম দেবে। সন্তানরা তাদের পিতামাতাকে সালাম দেবে। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, মুহাম্মদ (সা.) একবার একদল শিশু-কিশোরের কাছ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন, তখন তিনি তাদের সালাম দিলেন। (মুসলিম)। তাই আনাস (রা.)-ও ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হলে সালাম দিতেন। বড়রা উদার মনে হাসতে হাসতে শিশুদের সালাম দিলে শিশুরাও অন্যকে দ্রুত সালাম দিতে অভ্যস্ত হবে। শিশুদের মাঝে ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি জাগ্রত হবে। শিশুদের পক্ষ থেকে বড়দের শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের মন-মানসিকতা সৃষ্টি হবে।

সালামের ক্ষেত্রে প্রচলিত ভুল

সালাম একটি আরবি শব্দ। তাই এর উচ্চারণ শুদ্ধভাবে হওয়া আবশ্যক। অনেকেই সালাম দেন বটে; কিন্তু সঠিক ও শুদ্ধভাবে উচ্চারণ না হওয়ায় এর কোনো অর্থই হয় না। কোনো ধরনের সওয়াবও পাওয়া যায় না। অনেকে খুব দ্রুত বলেন, ‘স্লামালাইকুম’। এর কোনো অর্থ হয় না, তাই এরূপ বলা উচিত নয়। আবার অনেকে ফোনে কথা বলার সময় প্রথমে হ্যালো বলি, পরে সালাম দিই। এটাও অনুচিত। কারণ, সুন্নত হলো- প্রথমে সালাম দিয়ে কথাবার্তা শুরু করা। আমাদের উচিত, পরিবারে ও পরিবারের বাইরে বেশি বেশি সালামের প্রচলন করা; নিজেরা পরস্পর সালাম আদান-প্রদান করা এবং অন্যদের সালাম দিতে উৎসাহিত করা। পরিবারে মা-বাবা ও মুরুব্বিদের উচিত, ছোটবেলা থেকেই শিশুদের শুদ্ধরূপে ও সঠিক নিয়মে সালামের শিক্ষা দেয়া। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, জনসমাবেশে, অফিস-আদালতে সালামের আদান-প্রদান ও ব্যাপক প্রসার হওয়া কাম্য।

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা এরশাদ করেন-

তোমাকে যতটুকু সালাম প্রদান করা হয় প্রতিউত্তরে তারচেয়ে বেশি করে বাড়িয়ে সালামের জবাব দাও। (সুরা নিসা, আয়াত (৮৬))

কেউ যদি বলে, আস্‌সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, সালামদাতার এতটুকু বলাই সুন্নত, এর বেশি না। অর্থাৎ তোমার ওপর আল্লাহর পক্ষ হতে শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক। প্রতিউত্তরে বলতে হবে, ওয়াআলাই কুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ, অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ হতে তোমাকেও শান্তি, রহমত ও বারাকা দান করুন। প্রতিউত্তরে বাড়িয়ে বারাকাতুহ- এ পর্যন্তই বলা সুন্নত, কিন্তু সওয়াবের আশায় এর বেশি বাড়িয়ে বলা যাবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,

সালামদাতা প্রথম কথায় পেল বিশ নেকি আর সালামের উত্তরদাতা পেল ত্রিশ নেকি।

সুবহান আল্লাহ! মুসলমানদের জন্য এর চেয়ে বড় হাদিয়া আর কি হতে পারে। দেখা হলেই দোয়া। সব অবস্থায় সালাম দেওয়া জায়েজ শুধু টয়লেট ও নামাজরত অবস্থায় ব্যতীত। তবে নামাজের শেষে সালামের জবাব দিতে পারবে। আমাদের সমাজে একশ্রেণির মানুষ আছেন, যারা পায়ে ধরে সালাম করাকে বেশি আদব মনে করেন। তাদের ধারণাই নেই যে, সালাম হবে মুখে, পায়ে নয়। এটা বিজাতীয় প্রথা যা অজ্ঞতাবশত ইসলামে ঢুকে গেছে। যার ফলে মুসলমান একদিকে সওয়াব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অন্যদিকে বেদায়াত করছে। এটি পরিত্যাগ করে সঠিক পন্থায় সালামের প্রচলন চালু করতে হবে।

শয়তানের শয়তানি

শয়তানের সহজ প্ররোচনা হলো সালামে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে ছোট্ট একটা হিংসার বীজ বপন করা। সুরা আরাফে উল্লেখ আছে, শয়তান আল্লাহর কাছে ওয়াদা করেছিল যে, এই আদমের জন্য আমি জান্নাত থেকে বহিষ্কৃত হয়েছি। আয় আল্লাহ! আপনার বড়ত্বের কসম, আমি আদম জাতিকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সব ভালো কাজ থেকে গাফেল করে রাখব। মহান পরাক্রমশালী আল্লাহ! শয়তানের এই চ্যালেঞ্জের মুখে মুমিনদের জন্য দান করেছেন অজস্র নিয়ামত। সুবহানাল্লাহ! শয়তান কাউকে বাধ্য করে না, তবে শয়তানের কাজ হলো সুন্দর করে মানুষের চিন্তাধারায় বড়ত্ব সৃষ্টি করে তার ব্যক্তিত্বে অহংকার ঢুকিয়ে দেওয়া। শয়তানের ধোঁকায় পড়া মানুষগুলোই তার চারপাশের মানুষকে সম্মান দিতে পারে না। অথচ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বলতে ব্যবহারে পরিবেশ-পরিস্থিতির সামঞ্জস্য রক্ষা করাকে বোঝায়। একজন যাত্রী রিকশাওয়ালাকে সালাম দিবে- এতে সালামদাতার ব্যক্তিত্ব কমবে না বরং তার ব্যক্তিত্ব আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেবেন আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা।

হাদিসে এসেছে প্রথম সালামদাতা অহংকারমুক্ত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন; যার অন্ততে একটি সরিষা দানা পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পরবে না। সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত অহংকার নামক মারাত্মক ব্যাধি থেকে বাঁচার জন্য সালামের প্রতিযোগিতা করা। আল্লাহর পছন্দনীয় বান্দারাই সালামের মতো মহৎ গুণে অভ্যস্ত। তাই শয়তানের শয়তানি হলো মানুষকে অহংকারী বানিয়ে ইসলামের মৌলিক শিক্ষাগুলোকে বিকৃতভাষ্য হিসেবে প্রচলিত করে মানুষকে ইসলামের আদর্শ থেকে বঞ্চিত রাখা। কথিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.)কে একদিন এক ইহুদি বলেছিল, হে মুহাম্মদ! আসামু আালাইকা অর্থাৎ হে মোহাম্মদ তুমি ধ্বংস হও, প্রতিউত্তরে নবীজি (সা.) বলেছিলেন; ওয়া লাইকুম অর্থাৎ তুমি আমাকে যা দিলে আমি তোমাকে তাই দিলাম। সুতরাং শয়তানের শয়তানি থেকে বেঁচে থাকতে হলে ইসলামের সত্যটা জেনে-বুঝে মানতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন; অমুসলিমদের সালাম দেওয়া যাবে না, তবে তাদেরকে অভিবাদন জানাতে হবে দুনিয়ার কোনো প্রচলিত ভাষায়। কোনো মজলিসে, মুসলিম, মুশরিক, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মূর্তিপূজারি একাধিক ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বসা থাকলে সালাম দেওয়া যাবে, কেননা অসম্মানজনক কাজ ইসলামে নেই। সুতরাং অমুসলিমদের সালামের জওয়াবে বলতে হবে ওয়া লাইকুম।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসে সালামের চারটি গুণের কথা বলা হয়েছে– শান্তি, রহমত, বরকত ও অন্তরে ভালোবাসা পয়দা। যে পরিবারে সালামের প্রচলন থাকবে, সে ঘরে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা শান্তি, রহমত ও বরকতে ভরিয়ে দেবেন এবং যে সালাম দেবে তার হেফাজতকারী হয়ে যান আল্লাহ তায়ালা। যে সন্তান বাবা-মাকে সালাম দেবে এবং বাবা-মায়ের সালামের প্রতিউত্তরের মাধ্যমে যে সওয়ার পাবে, সেই সন্তান কোনো দিন বিপথগামী হবে না। যে সংসারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সালাম আদান-প্রদানের প্রচলন থাকবে, সে সংসারে কোনো দিন অনিষ্টকারী শয়তান কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। শয়তানের সবচেয়ে গর্বিত কাজ হলো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানো। এতে শয়তান তাদের নেতার পক্ষ হতে পুরস্কৃত হয়। সুতরাং সালাম বিচ্ছেদ নয় বরং ঐক্যবদ্ধ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কেউ যদি দূর থেকে সালাম পাঠায়, তাহলে তোমরা তার প্রতিউত্তরে বলবে, ওয়া আলাইকা ওয়া আলাইহি সালাম। সুরা নুর, আয়াত (২৭)। বলা হয়েছে, হে মুমিনগণ তোমরা নিজেদের ঘর ছাড়া অন্য কারও ঘরে কখনো প্রবেশ করবে না- যে পর্যন্ত তাদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় এবং সালাম দিয়ে তাদের অনুমতি ব্যতীত। তিনবার সালাম দেবে ভেতর থেকে সাড়া না এলে ভদ্রভাবে চলে আসবে। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা শেষ বিচারের দিন জান্নাতিদের প্রথম অভিবাদন জানাবেন সালামের মাধ্যমে। সালামুন কওলাম মির রব্বির রহিম- অর্থাৎ দয়ালু রবের পক্ষ হতে তোমাদের জন্য সালাম। আল্লাহু আকবার! জান্নাতে আর কোনো আমল ও ইবাদত নেই, আছে শুধু সালাম আর সালাম, শান্তি আর শান্তি।

সালামে আধুনিকতার কুফল

আমাদের সমাজে ইংরেজি শিক্ষার হার বেড়ে যাওয়ায় অধিকাংশ মানুষ সালামের পরিবর্তে হ্যালো ব্যবহার করে আর সালামকে সংক্ষিপ্ত করে বলে আসামু আলাইকা বা স্লা-মালিকুম আর প্রতিউত্তরে বলে আলাইকুম। সুতরাং তুমি যা আমিও তা। সালামের এই অশুদ্ধ উচ্চারণের প্রতিফলনে মানুষ শান্তি-শৃঙ্খলা ও রহমত-বরকত থেকে বঞ্চিত হয়ে অভিশাপ নিয়ে এক ধরনের মাতালের মতো জীবন যাপন করছে। অথচ এসব তাদেরই চাওয়া থেকে পাওয়া। তারা যা শোনে তাই বলে, আসলেই তারা জানে না, হ্যালো মানে- জাহান্নামি আর আসামু আলাইকা অথবা স্লা-মালিকুম মানে– তুমি মরে, তুমি ধ্বংস হও। স্মার্ট হওয়া ভালো তবে অতিরঞ্জিত কোনো কিছুই ভালো না। ইংরেজি ভাষা হচ্ছে মডার্ন আর আরবি হলো সুন্নাহ। সুতরাং কল্যাণের স্বার্থে ভাষার ব্যবহার প্রযোজ্য তবে, ইসলাম পরিপন্থী বিকৃত ভাষা মুসলমানদের পরিহার করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর, তাতেই কল্যাণ।

বিশ্বনবী রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, চারটি গুণ যার মধ্যে বিদ্যমান থাকবে, সে নিরাপদে জান্নাতে যেতে পারবে।

১) যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার আসায় সঠিকভাবে সালামের প্রচার-প্রসার ও আদান-প্রদান করবে, সে নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

২) যে ব্যক্তি কোনো ক্ষুধার্তকে খাবার খাওয়াবে, সে নিরাপদে জান্নাতে যাবে।

৩) যে মুসলিম আত্মীয়তার সম্পর্ক সঠিকভাবে রক্ষা করবে, সে ব্যক্তি নিরাপদে জান্নাতে যাবে।

৪) পৃথিবীর মানুষ যখন ঘুমে বিভোর থাকে, তখন যে ব্যক্তি আরামের ঘুম ত্যাগ করে কিয়ামুল লাইল আদায় করে, সে নিরাপদে জান্নাতে যাবে।

সালামের ব্যাপারে বৈষম্য

এই উচ্চশিক্ষার জ্ঞান গরিমা ও অর্থবিত্তের সমাজে অধিকাংশ মানুষ মনে করে থাকে যে, আমিই কেবল সালাম পাওয়ার যোগ্য, আমাকে সবাই সালাম দেবে। এ ধারণাটা ভুল। বিশ্ব নবী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনী থেকে জানা যায় তিনি দু-জাহানের বাদশা হয়েও বয়সে ছোট-বড় এবং অধীনস্থদের সর্বদায়ই আগে সালাম দিতেন। সুতরাং উম্মতে মুহাম্মদির উচিত ধনী-গরিব ঘরে বাইরে উপরস্থ-অধিনস্থ সবাইকে আগে সালাম দেওয়ার প্রতিযোগিতা করা। আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কত অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে পৃথিবীতে সালাম প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন, আর আমরা কিনা তাঁর উম্মত হয়ে শয়তানের উপাসনা করছি। প্রথমত শয়তানের কাজ হলো মানুষের অন্তরে হিংসা নামক ভাইরাস সংক্রামিত করে সব অন্তরজুড়ে হিংসা ছড়িয়ে দেওয়া। আর এই হিংসা-প্রতিহিংসা নিরাময়ের ভ্যাকসিন হলো সালাম। সুবহান আল্লাহ!

তাই তো আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.) বলেছেন,

তোমরা তোমাদের সমাজে সালামের প্রচার-প্রসার বাড়িয়ে দাও। দেখবে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তোমাদের জীবনকে শান্তি, রহমত, বরকত, নিরাপত্তা ও ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করে দেবেন।

সালাম প্রদানে কয়েকটি সুন্নত

১. সালামের অপেক্ষা করা : বহু মানুষের ধারণা ছোটরা ও অধস্তনরা সালাম দেবে এবং তারা উত্তর দেবে। তাই তারা অন্যের সালামের অপেক্ষা করে। ইসলামের শিক্ষা হলো বড়রাও ছোটদের সালাম দেবে; বরং যেকোনো বয়সের মানুষ আগে সালাম দিয়ে মর্যাদা লাভের চেষ্টা করবে।

২. সালাম শুনেও উত্তর না দেওয়া : কখনো কখনো অপছন্দের মানুষ সালাম দিলে ব্যক্তি তার উত্তর প্রদান করে না। অপছন্দনীয় ব্যক্তির সালামের উত্তর দেওয়াও ওয়াজিব।

৩. সালামের উত্তর দিয়ে আবার সালাম দেওয়া : উত্তম হলো ব্যক্তি আগে সালাম দেবে। কিন্তু কেউ যদি সালাম দিয়ে ফেলে তবে শুধু সালামের উত্তর দেওয়াই দায়িত্ব। পুনরায় সালাম দেওয়া অগ্রহণযোগ্য

৪. উত্তর না দিয়ে আবার সালাম : বড়রা সালাম দিলে কেউ কেউ উত্তর না দিয়ে আবার সালাম দেন। এ ধারণা থেকে সালাম দেওয়া তার দায়িত্ব ছিল। অথচ অন্য কেউ সালাম দিলেত তখন উত্তর দেওয়াই নিয়ম এবং ওয়াজিব।

৫. উত্তর না পেলে ‘সালাম দিয়েছি’ বলা : সালাম দেওয়ার পর উত্তর না পেলে সালাম দিয়েছি বলার রীতি আছে। এটা ঠিক নয়। নিয়ম হলো আবার সালাম দেওয়া এবং শ্রোতা সালাম শুনতে পায় এমনভাবে দেওয়া। সালামের উত্তর যেভাবে শুনিয়ে দিতে হয়, তেমনি সালামও শুনিয়ে দিতে হয়।

৬. নিম্ন স্বরে সালামের উত্তর দেওয়া : সালামের উত্তর শুনিয়ে দেওয়া ওয়াজিব। তাই নিম্ন স্বরে বা মনে মনে সালাম দেওয়ার অভ্যাস পরিহারযোগ্য।

৭. অসময়ে সালাম দেওয়া : সালাম শুভেচ্ছা ও সৌজন্য বিনিময়ের মাধ্যম। সাক্ষাতের সময় তা বিনিময় করাই নিয়ম। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় মোনাজাত ও জানাজা শেষে সালাম বিনিময় করেন। এটা একটি ভুল প্রচলন।

৮. ভুল উচ্চারণে সালাম দেওয়া : সালাম একপ্রকার ইবাদত। বিশুদ্ধ মনে সালাম বিনিময় করলে ব্যক্তি সাওয়াবের অধিকারী হয়। তাই বিশুদ্ধ উচ্চারণে সালাম প্রদান করা আবশ্যক। কিন্তু বহু মানুষকে ভুল উচ্চারণে সালাম দিতে দেখা যায়। যেমন স্লামালাইকুম, সালামালাইকুম, আস্লামালাইকুম, সেলামালাইকুম ইত্যাদি। সালামের সঠিক উচ্চারণ হলো, ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ’।

সালাম প্রদানে কয়েকটি সুন্নত :

১. যে যাকে সালাম দেবে :  সুন্নত হলো আরোহী ব্যক্তি পদাতিক ব্যক্তিকে সালাম দেবে। অল্পসংখ্য ব্যক্তি বেশি সংখ্যক লোককে সালাম দেবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আরোহী ব্যক্তি পদাতিক ব্যক্তিকে, পদাতিক ব্যক্তি বসা ব্যক্তিকে আর অল্পসংখ্যক ব্যক্তি বেশিসংখ্যক ব্যক্তিকে সালাম দেবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬২৩২)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, ছোটরা বড়দের সালাম দেবে।

২. আগে সালাম দেওয়ার চেষ্টা করা : সালাম আগে দেওয়া অনেক পূণ্যের কাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে উত্তম ব্যক্তি যে প্রথমে সালাম দেয়।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৫১৯৭)

৩. ঘরে প্রবেশের আগে সালাম প্রদান : ঘরে প্রবেশের পরে নয়, আগেই সালাম দেওয়া সুন্নত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা নিজেদের ঘর ছাড়া অন্য ঘরে প্রবেশের আগে অনুমতি চাও অথবা সালাম প্রদান করো।’ (সুরা নুর, আয়াত : ২৭)

মহানবী (সা.) আনাস (রা.)-কে বলেন, ‘হে বৎস, যখন তুমি তোমার পরিবারের কাছে ফিরবে, তখন তাদের সালাম দেবে। এটা তোমার ও তোমার ঘরবাসীর জন্য বরকতের কারণ হবে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৬৯৮)

৪. মধ্যম আওয়াজে সালাম দেওয়া : মিকদাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘এক রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) এলেন। তিনি সালাম দিলেন এমন আওয়াজে যে ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুম ভাঙল না এবং জাগ্রত ব্যক্তিরা তা শুনতে পেল।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২০৫৫)

৫. সমবেত মানুষের একজনকে সালাম না দেওয়া :  বৈঠক বড় হলে তিন দিকে ফিরে তিনবার সালাম দেওয়া। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৯৫)

৬. চেনা-অচেনা সবাইকে সালাম দেওয়া : পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে লক্ষ্য করে সালাম দেওয়া সুন্নত। এটি একজন আদর্শ মুসলিমের বৈশিষ্ট্য। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৮)

আয় আল্লাহ! আমাদেরকে ব্যাপকভাবে সালাম বিনিময় করার তৌফিক দান করুন।

সংগৃহীত

Views: 3