সূরা আল কাউসার পাঠের ফজিলত ও গুরুত্ব

নামকরণ:

সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত الكوثر কাউসার শব্দ থেকেই কাউসার নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া এ সূরাকে সূরা নাহারও বলা হয়। কাউসার দ্বারা উদ্দেশ্য হল হাউজে কাউসার, যা কিয়ামতের মাঠে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে প্রদান করা হবে।

শানে নুযূল:

আনাস বিন মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কিছুক্ষণ তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলেন। হঠাৎ মাথা তুলে হাসিমুখে বললেন অথবা তাঁর হাসির কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন:

এইমাত্র আমার ওপর একটি সূরা অবতীর্ণ হয়েছে। তারপর তিনি বিসমিল্লাহ বলে সূরা কাউসার পাঠ করলেন। অতঃপর তিনি বললেন: কাউসার কী তোমরা জান? জবাবে সাহাবাগণ বললেন: আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেন: কাউসার হলো : জান্নাতে একটি নহর আল্লাহ তা‘আলা আমাকে দান করেছেন, তাতে বহু কল্যাণ নিহিত রয়েছে। (আহমাদ ৩/১০২, সনদ সহীহ)

আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাঃ)-কে কাউসার দান করেছেন। ১. কাউসার দ্বারা জান্নাতের নহর উদ্দেশ্য। আয়িশাহ (রাঃ) কে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো, তিনি জবাবে বলেন :

কাউসার হলো জান্নাতের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত একটি নহর যা তোমাদের নাবী (সাঃ)-কে প্রদান করা হয়েছে। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৬৫)

এ ছাড়াও নাবী (সাঃ) থেকে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট হাদীস রয়েছে। ২. কাউসার দ্বারা দুনিয়া ও আখিরাতের অনেক কল্যাণকে বুঝানো হয়েছে। আর এ কল্যাণের মাঝে জান্নাতের কাউসার নামক নহরও শামিল। অধিকাংশ আলেম এ কথা বলেছেন। (ইবনু কাসীর, তাফসীর সা‘দী, তাফসীর মুয়াসসার।)

জান্নাতের হাউজে কাউসারের বিবরণ:

জান্নাতের হাউজে কাউসার বিদ্যমান। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন :

আল্লাহ তা‘আলার শপথ! আমি এখন আমার হাউজ প্রত্যক্ষ করছি। (সহীহ বুখারী হা. ২৪৬১, ৬১৩৭, সহীহ মুসলিম হা. ১৭২৭)

অন্যত্র তিনি বলেন :

আমার মিম্বার আমার হাউজে কাউসারের ওপর। (সহীহ বুখারী হা. ১১৮৮, ১১৯৬, সহীহ মুসলিম হা. ১৩৯১)

আল্লামা ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) তাঁর আক্বীদাহ ওয়াসিতিয়া গ্রন্থে হাউজের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:

হাউজের পানি দুধের চেয়ে সাদা, মধুর চেয়ে মিষ্টি, তার পেয়ালা আকাশের তারকার সংখ্যাতুল্য, যে ব্যক্তি একবার পান করবে পরবর্তীতে কখনও পিপাসার্ত হবে না, এর দৈর্ঘ্য এক মাসের দূরত্বের সমান এবং প্রস্থ এক মাসের দূরত্বের সমান। (আক্বীদাহ ওয়াসিতিয়াহ)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন :

কাউসার হলো একটি নহর যার ওয়াদা আল্লাহ তা‘আলা আমাকে দিয়েছেন। তাতে অনেক কল্যাণ নিহিত রয়েছে। কিয়ামতের দিন আমার উম্মত এ হাউজের নিকটে সমবেত হবে, যার পেয়ালা হবে তারকা সমতুল্য। কিছু লোককে হাউজ থেকে সরিয়ে দেয়া হবে, তখন আমি বলব : হে আমার প্রতিপালক! এরা আমার উম্মত। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন : তুমি জান না, তোমার পর তারা কত রকম বিদআত তৈরি করেছে। (সহীহ মুসলিম হা. ২২৯৯, আবূ দাঊদ হা. ৪৭৪৭)

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন :

মি‘রাজের রাতে আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম। হঠাৎ দেখি যে, আমি একটি নহরের পাশে দণ্ডায়মান যার দুপার্শ্বে মুক্তার তৈরি তাঁবু রয়েছে। তাতে পানি প্রবাহিত হয় তাতে হাত দিয়ে দেখলাম : তা মিশকের মত সুঘ্রাণযুক্ত। জিবরীল (রহঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম : এটা কী? জবাবে তিনি বললেন : এটা কাউসার যা আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে দিয়েছেন। (আহমাদ ৩/২৪৭, সনদ সহীহ।)

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলছেন:

‏ “বল : ‎ ‘আমার সলাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ শুধুমাত্র জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে।’ ‘তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি এরই জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।” (সূরা আনআম ৬ : ১৬৩-১৬৪)

 নাযিলের সময়–কাল

এটি মক্কী সূরা। 

ঐতিহাসিক পটভূমি

নবুওয়াতের প্রাথমিক যুগে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সবচেয়ে কঠিন সংকটের সম্মুখীন হয়েছিলেন , সমগ্র জাতি তাঁর সাথে শত্রুতা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল , বাধার বিরাট পাহাড়গুলো তাঁর পথে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল , চতুর্দিকে প্রবল বিরোধিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি ও তাঁর মুষ্টিমেয় কয়েকজন সাথী বহুদূর পর্যন্ত কোথাও সাফল্যের কোন আলামত দেখতে পাচ্ছিলেন না। তখন তাঁকে সান্ত্বনা দেবার ও তাঁর মনে সাহস সঞ্চারের জন্য মহান আল্লাহ বহু আয়াত নাযিল করেন এর মধ্যে সূরা দুহায় তিনি বলেন :

“ আর অবশ্যি তোমার জন্য পরবর্তী যুগ ( অর্থাৎ প্রত্যেক যুগের পরের যুগ ) পূর্ববর্তী যুগের চেয়ে ভালো এবং শীঘ্রই তোমার রব তোমাকে এমনসব কিছু দেবেন যাতে তুমি খুশী হয়ে যাবে। ”

অন্যদিকে আলাম নাশরাহে বলেন :

“ আর আমি তোমার আওয়াজ বুলন্দ করে দিয়েছি। ”

অর্থাৎ শত্রু সারা দেশে তোমার দুর্নাম ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে কিন্তু তাদের ইহার বিরুদ্ধে আমি তোমার নাম উজ্জ্বল করার এবং তোমাকে সুখ্যাতি দান করার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এই সাথে আরো বলেন :

“কাজেই , প্রকৃতপক্ষে সংকীর্ণতার সাথে প্রশস্ততাও আছে । নিশ্চিতভাবেই সংকীর্ণতার সাথে প্রশস্ততাও আছে ।” অর্থাৎ বর্তমানে কঠিন অবস্থা দেখে পেরেশান হয়ো না। শীঘ্রই এ দুঃখের দিনে শেষ হয়ে যাচ্ছে । সাফল্যের যুগ এই তো শুরু হয়ে যাচ্ছে।

এমনি এক অবস্থা ও পরিস্থিতিতে সূরা কাওসার নাযিল করে আল্লাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সান্ত্বনা দান করেন এবং তাঁর শত্রুদেরকে ধবংস করে দেবার ভবিষ্যদ্বাণী ও শুনিয়ে দেন।

কুরাইশ বংশীয় কাফেররা বলতো , মুহাম্মাদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমগ্র জাতি থেকে বিছিন্ন হয়ে গেছে। তার অবস্থা হয়ে গেছে একজন সহায় ও বান্ধবহীন ব্যক্তির মতো । ইকরামা (রা) বর্ণনা করেছেন : মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যখন নবীর পদে অধিষ্ঠিত করা হয় এবং তিনি কুরাইশদেরকে ইসলামরে দাওয়াত দিতে থাকেন তখন কুরাইশরা বলতে থাকে “মুহাম্মাদ নিজের প্রজাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এমন অবস্থায় পৌঁছে গেছে যেমন কোন গাছের শিকড় কেটে দেয়া হলে তার অবস্থা হয়। কিছুদিনের মধ্যে সেটি শুকিয়ে মাটির সাথে মিশে যায় ।” (ইবনে জারীর)

মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বলেন , মক্কার সরদার আস ইবেন ওয়ায়েল সাহমির সামনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা উঠলেই সে বলতো : “সে তো একজন আবতার অর্থাৎ শিকড় কাটা। কোন ছেলে সন্তান নেই। মরে গেলে তার নাম নেবার মতো কেউ থাকবে না।”

ইবনে আব্বাসের (রা) বর্ণনা মতে , একবার কাব ইবনে আশরাফ ( মদীনার ইহুদি সরদার) মক্কায় আসে। কুরাইশ সরদাররা তাকে বলে : “এ ছেলেটির ব্যাপারে–স্যাপার দেখো। সে তার জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সে মনে করে, সে আমাদের থেকে ভালো । অথচ আমরা হজ্জের ব্যবস্থাপনা করি, হাজীদের সেবা করি ও তাদের পানি পান করাই। ” ( বায্‌যার )

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেন : রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সবচেয়ে বড় ছেলের নাম কাসেম (রা), তার ছোট ছিলেন হযরত যয়নব (রা) । তার ছোট ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ (রা) । তারপর জন্ম নেয় যথাক্রমে তিন কন্যা ; হযরত উম্মে কুলসুম (রা) , হযরত ফাতেমা (রা) ও হযরত রুকাইয়া (রা)।এদের মধ্যে সর্ব প্রথম মারা যান হযরত কাসেম। তারপর মারা যান হযরত আবদুল্লাহ । এ অবস্থা দেখে আস ইবনে ওয়ায়েল বলে, তার বংশই খতম হয়ে গেছে। এখন সে আবতার (অর্থাৎ তার শিকড় কেটে গেছে ) । কোন কোন রেওয়ায়াতে আরো একটু বাড়িয়ে আসের এই বক্তব্য এসেছে : “ মুহাম্মাদ একজন শিকড় কাটা । তার কোন ছেলে নেই , সে তার স্থালাভিষিক্ত হতে পারে । সে মরে গেলে তার নাম মিটে যাবে। আর তখন তোমরা তার হাত থেকে নিস্তার পাবে। ”

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুত্র আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর আবু জেহেলও এই ধরনের কথা বলেছিল। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শোকে আনন্দ প্রকাশ করতে গিয়ে উকবা ইবেন আবী মু’আইতও এই ধরনের হীন মনোবৃত্তির পরিচয় দেয়। আতা বলেন , রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বিতীয় পুত্রের ইন্তিকালের পর তাঁর চাচা আবু লাহাব ( তার ঘর ছিল রসূলের ঘরের সাথে লাগোয়া ) দৌড়ে মুশরিকদের কাছে চলে যায় এবং তাদের এই “ সুখবর ” দেয় : রাতে মুহাম্মাদ সন্তানহারা হয়ে গেছে অথবা তার শিকড় কেটে গেছে।”

এ ধরনের চরম হতাশাব্যাঞ্জক পরিস্থিতিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর সূরা কাউসার নাযিল করা হয়। তিনি কেবল আল্লাহর বন্দেগী করতেন এবং আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করাকে প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এ কারণে কুরাইশরা ছিল তাঁর প্রতি বিরূপ । এ জন্যই নবুওয়াত লাভের আগে সমগ্র জাতির মধ্যে তাঁর যে মর্যাদা ছিল নবুওয়াতলাভের পর তা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। তাঁকে এক রকম জ্ঞাতি–গোত্র থেকে বিছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল। তাঁর সংগী–সাথী ছিলেন মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক। তারাও ছিলেন বন্ধু–বান্ধব ও সহায়–সম্বলহীন । তাঁরাও জুলুম–নিপীড়ন সহ্য করে চলছিলেন । এ সাথে তাঁর একের পর এক সন্তানের মৃত্যুরে তাঁর ওপর যেন দুঃখ ও শোকের পাহাড় ভেঙে পড়েছিল। এ সময় আত্মীয়–স্বজন, জ্ঞাতিগোষ্ঠী ও প্রতিবেশীদের পক্ষ থেকে যিনি শুধু আপন লোকদের সাথেই নয় , অপরিচিত ও অনাত্মীয়দের সাথেও সবসময় পরম প্রীতিপূর্ণ ও সহানুভূতিশীল ব্যবহার করছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে এ ধরনের বিভিন্ন অপ্রীতিকর কথা ও আচরণ তাঁর মন ভেঙে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। এ অবস্থায় এ ছোট্ট সূরাটির একটি বাক্যে আল্লাহ তাঁকে এমন একটি সুখবর দিয়েছেন যার চাইতে বড় সুখবর দুনিয়ার কোন মানুষকে কোন দিন দেয়া হয়নি। এই সংগে তাঁকে এ সিদ্ধান্তও শুনিয়ে দেয়া হয়েছে যে , তাঁর বিরোধিতাকারীদেরই শিকড় কেটে যাবে।

আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত করার জন্য। সূরা আল কাউসারে আল্লাহর তাওহীদ তথা একত্ববাদের বাণী এসেছে। আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর শরীক না করার কথা পবিত্র কোরআনে বারবার এসেছে। সূরা কাউসারেও এ সম্পর্কিত নির্দেশ এসেছে। সূরা কাউসারের দ্বিতীয় আয়াতে এই নির্দেশ এবং একিসঙ্গে আল্লাহা তায়ালার উদ্দ্যেশ্যে কোরবানি দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তৃতীয় আয়াত যেসব কাফের নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে নির্বংশ বলে দোষারোপ করত তাদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। অধিকাংশ রেওয়ায়েত মতে এই আয়াতে,‘আস ইবনে ওয়ায়েল এবং কোনো কোনো রেওয়ায়েত মতে ওকবা এবং কোনো কোনো রেওয়ায়েত মতে, কা’ব ইবনে আশরাফকে বোঝানো হয়েছে।

ফজিলত পূর্ণ এই সূরা আল কাউসার পাঠের অন্যতম একটি ফজিলত হচ্ছে এটি পাঠে শত্রুর অনিষ্ট হতে মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের রক্ষা করে থাকেন। নামাজের সঙ্গে পড়ার লক্ষ্যেও ছোট এই সূরা শিখে নেয়া অনেক সহজ।

মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের পবিত্র কোরআন বুঝে পড়ার এবং সঠিক আমল করার তাফিক দান করুক। আমিন।

সংগৃহীত

Views: 3,034