সুরা ইখলাস। কুরআনুল কারিমের ১১২তম ও ছোট সুরা এটি। যে সুরা তেলাওয়াতের মাধ্যমে মানুষ সবচেয়ে বেশি ফজিলত ও নেয়ামত পায় সেটি হলো সুরা ইখলাস। আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরা ৪ আয়াত বিশিষ্ট ছোট্ট সুরাটি হিজরতের আগে মক্কায় অবতীর্ণ হয়। সুরার নামের অর্থ থেকেই এর ফজিলত, মর্যাদা ও নেয়ামত প্রকাশ পায়।

উচ্চারণ : কুল হুয়াল্লাহু আহাদ। আল্লাহুচ্চামাদ। লাম ইয়ালিদ ওয়া লাম ইউলাদ। ওয়া লাম ইয়াকুল্লাহু কুফুয়ান আহাদ।’

অর্থ : (হে রাসুল! আপনি) বলুন, তিনিই আল্লাহ, একক। আল্লাহ অমুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি। আর তার সমতুল্য কেউ নেই।’

সুরার নাম ‘ইখলাস’। যার অর্থ হলো- একনিষ্ঠতা, নিরেট খাঁটি বিশ্বাস, ভক্তিপূর্ণ উপাসনা। দুনিয়ার সব বিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার একত্ববাদের ওপর খাঁটি ও নিরেট বিশ্বাসী হওয়াকে ইখলাস বলে।

সুরার নামকরণ
সুরার প্রকৃত মর্মার্থের ভিত্তিতেই সুরাটির নামকরণ করা হয়েছে। এ সুরাটিতে মহান আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এ সুরাটি মানুষকে নিশ্চিত শিরক থেকে মুক্তি দিয়ে একত্ববাদের উপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস স্থাপনে মানুষ হয় মুখলিস বান্দায় পরিণত হয়।

সুরার বৈশিষ্ট্য
সুরাটির অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআলার শেখানো ভাষায় তাঁর পরিচয় তুলে ধরেছেন। যে পরিচয় তুলে ধরতে আল্লাহ তাআলা নিজেই এ সুরাটি নাজিল করেছেন। এ সুরার মতো কোনো সুরায় আল্লাহর একত্ত্ববাদের বিষয়টি বর্ণিত হয়নি। আল্লাহর সৃষ্টিরহস্যের নিরসণ করা হয়েছে এ সুরায়।

সুরাটি নাজিলের কারণ
হজরত আনাস রাদিয়ল্লাহু আনহু বলেন, ‘খায়বারের কয়েকজন ইয়াহুদি একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে এসে বলল- হে আবুল কাসেম! আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের নূর থেকে, আদমকে মাটি থেকে এবং পৃথিবীকে পানির ফেনা থেকে সৃষ্টি করেছেন। এখন আপনার রব সম্পর্কে আমাদের জানান, তিনি কোন বস্তু থেকে সৃষ্ট? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন কোনো জবাব দেননি। অতপর (তাদের উত্তরে) হজরত জিবরিল আলাইহিস সালাম সুরা ইখলাস নিয়ে হাজির হন।

হজরত আয়েশা (রা.)–র কাছ থেকে এক রেওয়ায়েতে উল্লেখ আছে, এক যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ (সা.) একজন লোককে নেতা নিযুক্ত করে দেন, তিনি নামাজে ইমামতি করার সময় সুরা ফাতিহা এবং অন্য সুরা শেষে প্রতি রাকাতেই সুরা ইখলাস পড়তেন।যুদ্ধ থেকে ফিরে লোকেরা এ নিয়ে অভিযোগ করলে তিনি লোকটিকে ডেকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করেন। লোকটি উত্তর দেন যে এই সুরায় তিনি আল্লাহর পরিচয় পান, তাই এই সুরাকে ভালোবাসেন। এ কথা শুনে রাসুল (সা.) বললেন, তাহলে আল্লাহও তোমাকে ভালোবাসেন। হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.)–র বরাতে বলা হয়েছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
যে ব্যক্তি তিনটি কাজ ইমানের সঙ্গে করতে পারবে জান্নাতের যেকোনো দরজা দিয়ে সে প্রবেশ করতে পারবে: ১. যে হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেবে। ২. যে গোপন ঋণ পরিশোধ করবে। ৩. যে প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর ১০ বার সুরা ইখলাস পাঠ করবে। (তাফসিরে কাসির)

 

হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একদিন নাজরানের সাতজন খ্রিস্টান পাদ্রি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। অতপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন- ‘আমাদের বলুন, আপনার রব কেমন? তিনি কিসের তৈরি? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমার রব কোনো জিনিসের তৈরি নয়। তিনি সব বস্তু থেকে আলাদা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা সুরা ইখলাস নাজিল করেন।

সুরা ইখলাসের বিষয়বস্তু
আল্লাহ তাআলা তার পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে সুরা ইখলাসের ৪ আয়াতের মাধ্যমে ৪টি বিষয় তুলে ধরেছেন। আর তাহলো-
– আল্লাহ এক। এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা তার একত্ববাদের সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন।
– তিনি অমুখাপেক্ষী। এ আয়াতে তিনি কোনো কিছুতেই মুখাপেক্ষী নন। কারো কাছে তার কোনো প্রয়োজন নেই। সব কিছুতেই তিনিই যথেষ্ট।
– তার জন্ম-সৃষ্টিতে কারো কোনো হাত নেই। তিনি কারো জনক নন আবার তাকে কেউ জন্ম দেননি। তিনি জন্ম-সৃষ্টি দেয়া ও হওয়া থেকে পূত-পবিত্র এবং মুক্ত।
– জন্মের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই এবং চতুর্থ আয়াতে বলা হয়েছে, তিনি অতুলনীয়। চারটি আয়াতের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদ।
– তার সমকক্ষ কেউ নেই। অর্থাৎ তিনি যে এক ও একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। তার ওপর তাকিদ করা হয়েছে, সত্যয়ন করা হয়েছে যে, তার সমকক্ষ কেউ নেই।

সুরাটির মর্যাদা
সুরা ইখলাস অনন্য মর্যাদা সম্পন্ন ৪ আয়াত বিশিষ্ট ছোট্ট একটি সুরা। সুরাটিকে কুরআনের ৩ ভাগের এক ভাগ ঘোষণা করা হয়েছে। হাদিসে এসেছে, হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,

‘এক ব্যক্তি রাতের বেলা অন্য ব্যক্তিকে বার বার সুরা ইখলাস পড়তে শুনেছেন। সকাল হলে বিষয়টি রাসুলু্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবহিহত করা হয়। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ওই সত্তার শপথ! যার কুদরতি হাতে আমার প্রাণ। অবশ্যই এ সুরা কুরআন মাজিদের এক-তৃতীয়াংশের সমান।’ (বুখারি, আবু দাউদ, নাসাঈ, মুয়াত্তা মালেক)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন সাহাবিদের বললেন, তোমারা কি এক রাতে কুরআন মাজিদের ৩ ভাগের একভাগ পড়তে পারবে? সাহাবিরা এ প্রস্তাবকে খুবই কঠিন মনে করলেন। ফলে তারা বলল, আমাদের মধ্যে এ কাজ কে করতে পারবে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, সুরা ইখলাস কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান।’ (বুখারি, নাসাঈ)

হজরত আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

‘আল্লাহ তাআলা কুরআনকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। আর এ সুরাটি (সুরা ইখলাস)-কে একটি ভাগে পরিণত করেছেন।’ (মুসলিম, তিরমিজি)

হজরত ওকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি তোমাদেরকে এমন তিনটি সুরার কথা বলছি, যা তাওরাত, ইঞ্জিল, জবুর এবং কুরআনে অবতীর্ণ হযেছে। রাতে তোমরা ততক্ষণ ঘুমাতে যেয়ো না, যতক্ষণ সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস না পাঠ কর। ওকবা বলেন, সেদিন থেকে আমি কখনও এ আমল পরিত্যাগ করিনি।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)

 

সুরা ইখলাসের ফজিলত
সুরা ইখলাস-এর ভাব ও মর্মার্থ বুঝে পড়লে তাতে বান্দার অন্তরে আল্লাহর গুণাবলী গেঁথে যাবে। মনে প্রাণে ওই ব্যক্তি হয়ে উঠবে শিরকমুক্ত ঈমানের অধিকারী হবে। আর তার বিনিময়ে সে লাভ করবে দুনিয়া ও পরকালের অনেক উপকারিতা ও ফজিলত।

>> আল্লাহর ভালোবাসা লাভ
কোনো এক যুদ্ধের সেনাপতি জামাআতে নামাজ পড়ার সময় সুরা ইখলাস দিয়ে নামাজ পড়ান। যুদ্ধ থেকে ফিরে সৈন্যরা বিষয়টি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তা অবহিত করেন। তিনি তাদের বললেন, ‘তোমরা তাকে জিজ্ঞাসা কর কেন সে এরূপ করেছে। তখন সে সেনাপতি জানান, এ সুরায় আল্লহার গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে বিধায় আমি এ সুরাকে ভালোবাসি।’ বিষয়টি জানার পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদের জানান, ‘তোমরা তাকে গিয়ে বলো, আল্লাহও তাকে ভালোবাসেন।’ (বুখারি, মুসলিম, নাসাঈ)

>> জান্নাত লাভ
একবার এক সাহাবা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি সুরা ইখলাসকে ভালোবাসি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বলেন, এ ভালোবাসা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে।’ (বুখারি, তিরমিজি)

 

>> গোনাহ থেকে মুক্তি
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রতিদিন ২০০ বার সুরা ইখলাস পড়বে, তার ৫০ বছরের গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। তবে ঋণগ্রস্ত হলে তা ক্ষমা হবে না।’ (তিরমিজি)

>> দারিদ্র্যতা থেকে মুক্তি
হজরত সাহল ইবন সাদ সায়েদি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে দারিদ্র্যতার অভিযোগ করল তিনি বললেন, ‘যখন তুমি ঘরে যাও তখন সালাম দেবে এবং একবার সুরা ইখলাস পড়বে। এ আমল করার ফলে কিছু দিনের মধ্যে তার দারিদ্র্যতা দূর হয়ে যায়।’ (তাফসিরে কুরতুবি)

>> রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পাঠ করে তা তাকে বালা-মসিবত থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট হয়।’ (ইবনে কাসির)

>> রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে সুরা ইখলাস তেলাওয়াত করতে শুনলেন। তিনি বললেন, ‘এটা তার অধিকার।’ সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন, তার অধিকার কী? তিনি উত্তরে বললেন- ‘তার অধিকার হচ্ছে জান্নাত।’ (মুসনাদে আহমাদ)

উল্লেখ যে, অনেকেই বলে থাকেন, সুরা ইখলাস ৩ বার পাঠ করলে সম্পূর্ণ কুরআনুল কারিম তেলাওয়াতের সাওয়াবের অধিকারী হয় বা কুরআন খতমের সমান। আসলে বিষয়টি এমন নয়। হাদিসের কোথাও সাওয়াব প্রাপ্তি কিংবা সম্পূর্ণ কুরআন খতম হওয়ার বিষয়টি বলা হয়নি।

সুরা ইখলাসে তওহিদের শিক্ষা

ইসলামের মর্ম হচ্ছে তওহিদ। এ সুরায় শেখানো হয়, আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তিনি কাউকে জন্ম দেননি, তিনি কারও থেকে জন্ম নেননি, কোনো কিছুর সমতুল্য নন তিনি।

কোরআন শরিফ আমাদের তিনটি মৌলিক জিনিস শেখায়:

১.তওহিদ

২.আখিরাত

৩.রিসালাত

অর্থাৎ আল্লাহ, পরকাল ও অহি। অন্য যেকোনো বিশ্বাস এই তিনটার মধ্যে পড়ে যায়। আল্লাহ, আখিরাত এবং আল্লাহর প্রেরিত ওহির প্রতি বিশ্বাস। যখন আমরা বলি আল্লাহকে বিশ্বাস করি, এর মধ্যে আল্লাহর সব নাম, সব গুণ, কাজকে বোঝায়। যখন বলি, আখিরাতে বিশ্বাস, তার মধ্যে কবরের জীবন, বিচার দিবস, জান্নাত, জাহান্নাম-সব এসে যায়।

সুরা ইখলাসে আল্লাহর ভালোবাসা লাভ

হজরত আয়েশা (রা.) থেকে এক রেওয়ায়েতে উল্লেখ আছে, এক যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে আমির বা নেতা নিযুক্ত করে দেন, তিনি নামাজে ইমামতিকালে সুরা ফাতিহা ও অন্য সুরা শেষে প্রতি রাকাতেই সুরা ইখলাস পাঠ করতেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে লোকেরা এ ব্যাপারে অভিযোগ করলে তিনি তাঁকে ডেকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করেন, নেতা উত্তর দেন যে এই সুরায় আল্লাহর পরিচয় পাই, তাই এই সুরাকে ভালোবাসি। এ কথা শুনে রাসুল (সা.) বললেন, তাহলে আল্লাহও তোমাকে ভালোবাসেন।

হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন,

যে ব্যক্তি তিনটি কাজ ইমানের সঙ্গে করতে পারবে জান্নাতের যেকোনো দরজা দিয়ে সে প্রবেশ করতে পারবে। (১) যে হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেবে। (২) যে ব্যক্তি গোপন ঋণ পরিশোধ করবে। (৩) এবং যে প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর ১০ বার সুরা ইখলাস পাঠ করবে (তাফসিরে কাসির)।

সূরা ইখলাস তিলাওয়াকারীকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়

আবুল হাসান মুহাজির রাহ. বলেন, জনৈক সাহাবী বর্ণনা করেছেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে এক সফরে ছিলেন। (একদিন তাঁর কাছে এমনভাবে বসা ছিলেন যে,) তার হাঁটুদুটি নবীজীর হাঁটুদ্বয়ের সঙ্গে লেগে ছিল। এ অবস্থায় এক লোককে শুনলেন, সূরা কাফিরূন তিলাওয়াত করছে। তা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে শিরক থেকে পবিত্র হয়ে গেছে। আরেক লোককে শুনলেন, সূরা ইখলাছ তিলাওয়াত করছে। তখন তিনি বললেন, তাকে মাফ করে দেওয়া হয়েছে।

সূরা ইখলাছের মহব্বত তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে

সূরা ইখলাছের সাথে মহব্বত ও আমলের সম্পর্ক এমনই ফযীলতের বিষয় যে, তা বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে জান্নাতে পৌঁছে দেয়। আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন, জনৈক আনসারী সাহাবী মসজিদে কোবায় ইমামতি করতেন। তার অভ্যাস ছিল, সূরা ফাতেহার সাথে অন্য সূরা মেলানোর আগে অবশ্যই সূরা ইখলাছ পড়তেন, এরপর অন্য সূরা পড়তেন। প্রতি রাকাতেই তিনি এমন করতেন। তার সাথীসঙ্গিরা আপত্তি জানালেন। তারা বললেন, আপনি প্রত্যেক রাকাতে সূরা ইখলাছ পড়েন, কিন্তু এই সূরাকে যথেষ্ট মনে করেন না; বরং এর সাথে আরেক সূরা তিলাওয়াত করেন। আপনি হয় শুধু সূরা ইখলাছ পড়ুন, না হয় শুধু অন্য সূরা পড়ুন। (সূরা ফাতেহার পর প্রতি রাকাতে দুই সূরা পড়বেন না।)

তিনি বললেন, এই সূরা আমি ছাড়তে পারব না এবং আমি নামায পড়ালে এভাবেই পড়াব। তোমাদের পছন্দ হলে ইমামতি করব, না হয় ছেড়ে দেব। সেই সাহাবী ছিলেন তাদের দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ মানুষ। তাই অন্য কেউ ইমামতি করবেএটা তারা পছন্দ করেননি। একদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে কোবায়  এলেন। তাঁর কাছে বিষয়টি উত্থাপন করা হল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ সাহাবীকে ডেকে বললেনতোমার সাথীদের কথা মানতে বাধা কী? প্রতি রাকাতে আবশ্যিকভাবে সূরা ইখলাছ পড়ার কারণ কী? সাহাবী উত্তর দিলেন– আমি সূরা ইখলাছকে মহব্বত করি।

তার জবাব শুনে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনসূরা ইখলাছের প্রতি তোমার এই মহব্বত তোমাকে জান্নাতে দাখেল করবে। জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯০১; আলআহাদীসুল মুখতারাহ ৫/১২৯, হাদীস ১৭৫০, সহীহ বুখারী, আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন

জনৈক সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে আরয করল, (ইয়া রাসূলাল্লাহ!) قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ সূরাটিকে আমি ভালবাসি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এই সূরার ভালবাসা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। 

তার জন্য জান্নাত অবধারিত

আবু হুরায়রা রা. বলেন, আমি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম। এক ব্যক্তি তিলাওয়াত করছিল

قُلْ هُوَ اللهُ اَحَدٌ ، اَللهُ الصَّمَدُ، لَمْ یَلِدْ  وَ لَمْ یُوْلَدْ، وَ لَمْ یَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌ.

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুনে বললেনওয়াজিব হয়ে গেছে।

আমি জিজ্ঞেস করলামকী ওয়াজিব হয়েছে, আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেনজান্নাত। মুয়াত্তা মালেক, হাদীস ২৫৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮০১১; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৮৯৭; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ৯৯৪; মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ২০৭৯

তাকে জান্নাতের খোশখবরি দান করো

আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন, আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বসা ছিলাম। এক লোক এসে বলল, আমার এক ভাই এই সূরা (সূরা ইখলাছ) পড়তে ভালবাসে।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার ভাইকে জান্নাতের সুসংবাদ দাও। আলকামেল, ইবনে আদী ২/৩৯০; মুসনাদে বায্যার, হাদীস ৬৭৩১; ফাযায়েলে কুরআন, মুসতাগফিরী, হাদীস ১০৫০

স্বয়ং আল্লাহ যাকে মহব্বত করেন

মুমিনের জীবনের সবচেয়ে বড় আরাধনা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মহব্বত ও ভালবাসার নিআমত। যারা সূরা ইখলাছ বেশি বেশি পাঠ করে তাদের প্রতি আল্লাহ তাআলা রহমতের দৃষ্টি দেন এবং তারা আল্লাহ তাআলার প্রিয়পাত্র হয়ে যান। এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে! এর থেকে বড় অর্জন আর কী থাকতে পারে!

যার জানাযায় সত্তর হাজার ফেরেশতা শরীক হয়েছেন

হাদীস শরীফে এসেছে, মুআবিয়া ইবনে মুআবিয়া আলমুযানী আললাইছী রা. ইন্তেকাল করলে সত্তর হাজার ফেরেশতাসহ জিবরীল আলাইহিস সালাম নবীজীর কাছে আগমন করেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরীল আলাইহিস সালাম ও এইসব ফেরেশতাদের নিয়ে তার জানাযায় শরীক হন।

নামায শেষ হলে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন

হে জিবরীল! কোন্ আমলের মাধ্যমে মুআবিয়া ইবনে মুআবিয়া মুযানী এই উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে?

জিবরীল আলাইহিস সালাম জবাবে বলেছেন

এই মর্যাদা লাভের কারণ হল, সে দাঁড়িয়ে, বসে, হেঁটেহেঁটে, সওয়ারীতে তথা সর্বাবস্থায় সূরা ইখলাছ তিলাওয়াত করত। মুজামে কাবীর ৮/১১৬, হাদীস ৭৫৩৭; মুজামে আওসাত, তবারানী, হাদীস ৩৮৭৪; মুসনাদুশ শামিয়্যীন, ২/১২১৩ ৮৩১; আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লায়লাহ, ইবনে সুন্নী, হাদীস ১৮০

আরেক বর্ণনায় এসেছে, নবীজী জিজ্ঞেস করলেন– 

হে জিবরীল! কোন্ আমল দ্বারা মুআবিয়া ইবনে মুআবিয়া আল্লাহর নিকট এই মর্যাদা লাভ করেছে?

জিবরীল আ. উত্তর দিয়েছেন

এর কারণ হল, সে সূরা ইখলাছকে মহব্বত করত এবং চলতেফিরতে, উঠতেবসতে সর্বাবস্থায় এই সূরা তিলাওয়াত করত। মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৪২৬৮

সংগৃহীত

Views: 336