শানে নুযুল
এই সুরার শানে নুযুল হলো- সূরা ফালাক ও সুরা নাস একসঙ্গে নাজিল হয়েছে। এই দুই সুরা নাজিলের প্রেক্ষাপট বা শানে নুযূল হল, হুদাইবিয়ার ঘটনার পর লাবীদ ইবনে আসাম এবং তার কন্যারা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর যাদু করেছিল। ফলে তিনি কিছুটা কষ্ট অনুভব করেন এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন।
ফেরেশতাদের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা যাদুকরের নাম এবং কোথায়, কিভাবে যাদু করা হয়েছে এ সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছেন। চিরুনী ও চুলের সাহায্যে যাদু করা হয়, যা যারওয়ান কূপের তলদেশে একটি পাথরের নিচে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। এ সুরাটি নাজিল হওয়ার পর ফেরেশতাদের বিবরণ অনুযায়ী ওই কূপ থেকে তা তুলে আনা হয়। অতপর ওই সূরাটি পড়ে গিরা খুললে তৎক্ষণাত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুস্থ হয়ে উঠেন। এই সূরাটি পড়লে অনিষ্ট ও যাদু থেকে হেফাজতে থাকা যায়।

বাংলা উচ্চারণ :
কুল আউযু বিরাব্বিন নাস, মালিকিন্ নাস, ইলাহিন্ নাস, মিন্ শররিল ওয়াস্ ওয়াসিল খান্নাস, আল্লাযী ইউওযাসবিসু ফী ছুদুরিন্নাস, মিনা জিন্নাতি ওয়ান্নাস।
অর্থ : ‘বলো, আমি শরণ নিচ্ছি মানুষের প্রতিপালকের, মানুষের অধীশ্বরের, মানুষের উপাস্যের, তার কুমন্ত্রণার অমঙ্গল হতে, যে সুযোগ মতো আসে ও সুযোগমতো সরে পড়ে, যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে, জিন বা মানুষের মধ্য থেকে।’
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য
মক্কা মু’আয্যমায় এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে এ সূরাটি নাযিল হয়েছিল। তখন ইসলামী দাওয়াতের সূচনা পর্বেই মনে হচ্ছিল , রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেন ভীমরুলের চাকে হাত দিয়ে ফেলেছেন। তাঁর দাওয়াত যতই বিস্তার লাভ করতে থেকেছে কুরাইশ বংশীয় কাফেরদের বিরোধিতাও ততোই বেড়ে যেতে থেকেছে। যতদিন তাদের আশা ছিল কোনরকম দেয়া-নেয়া করে অথবা ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে তাঁকে ইসলামী দাওয়াতের কাজ থেকে বিরত রাখতে পারা যাবে , ততদিন তো বিদ্বেষ ও শত্রুতার তীব্রতার কিছুটা কমতি ছিল। কিন্তু নবী করীম (সা) যখন দীনের ব্যাপারে তাদের সাথে কোন প্রকার আপোষ রফা করার প্রশ্নে তাদেরকে সম্পূর্ণ নিরাশ করে দিলেন এবং সূরা আল কাফেরুনে তাদেরকে দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলে দিলেন — যাদের বন্দেগী তোমরা করছো আমি তার বন্দেগী করবো না এবং আমি যার বন্দেগী করছি তোমরা তার বন্দেগী করো না , কাজেই আমার পথ আলাদা এবং তোমাদের পথ ও আলাদা — তখন কাফেরদের শত্রুতা চরমে পৌঁছে গিয়েছিল। বিশেষ করে যেসব পরিবারের ব্যক্তিবর্গ ( পুরুষ-নারী , ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে) ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাদের মনে তো নবী করীমের (সা) বিরুদ্ধে সবসময় তুষের আগুন জ্বলছিল। ঘরে ঘরে তাঁকে অভিশাপ দেয়া হচ্ছিল। কোন দিন রাতের আঁধারে লুকিয়ে তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। যাতে বনী হাশেমদের কেউ হত্যাকরীর সন্ধান পেয়ে আবার প্রতিশোধ নিতে না পারে এ জন্য এ ধরনের পরামর্শ চলছিল। তাঁকে যাদু – টোনা করা হচ্ছিল। এভাবে তাঁকে মেরে ফেলার বা কঠিন রোগে আক্রান্ত করার অথবা পাগল করে দেয়ার অভিপ্রায় ছিল। জিন ও মানুষদের মধ্যকার শয়তানরা সব দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা চাচ্ছিল জিন মানুষের মনে তাঁর এবং তিনি যে দীন তথা জীবন বিধান কুরআন এনেছেন তার বিরুদ্ধে কোন না কোন সংশয় সৃষ্টি করতে। এর ফলে লোকেরা তাঁর প্রতি বিরূপ ধারণা করে দূরে সরে যাবে বলে তারা মনে করছিল। অনেক লোকেরা মনে হিংসার আগুন জ্বলছিল। কারণ তারা নিজেদের ছাড়া বা নিজেদের গোত্রের লোকদের ছাড়া আর কারো প্রদীপের আলো জ্বলতে দেখতে পারতো না। উদাহরণ স্বরূপ , আবু জেহেল যে কারণে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতায় সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল সেটি ছিল তার নিজের ভাষায় : “ আমাদের ও বনী আবদে মান্নাফের ( তথা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিবার ) মধ্যে ছিল পারস্পরিক প্রতিযোগিতা । তারা মানুষকে আহার করিয়েছে , আমরা ও আহার করিয়েছি । তারা লোকদেরকে সওয়ারী দিয়েছে , আমরা ও দিয়েছি। তারা দান করেছে , আমরাও দান করেছি। এমন কি তারা ও আমরা মান মর্যাদার দৌঁড়ে সামনে সমান হয়ে গেছি। এখন তারা বলছে কি , আমাদের মধ্যে একজন নবী আছে , তার কাছে আকাশ থেকে অহী আসে। আচ্ছ , এখন কি এ ক্ষেত্রে আমরা তাদের সাথে কেমন করে মোকাবেলা করতে পারি ? আল্লাহর কসম , আমরা কখনো তাকে মেনে নেবো না এবং তার সত্যতার স্বীকৃতি দেবো না। ” ( ইবনে হিশাম , প্রথম খণ্ড , ৩৩৭-৩৩৮ পৃষ্ঠা )
এহেন অবস্থায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলা হয়েছে : এদেরকে বলে দাও আমি আশ্রয় চাচ্ছি সকাল বেলার রবের , সমুদয় সৃষ্টির দুষ্কৃতি ও অনিষ্ট থেকে , রাতের আঁধার থেকে যাদুকর ও যাদুকারিণীদের অনিষ্ট থেকে এবং হিংসুকদের দৃষ্কৃতি থেকে । আর এদেরকে বলে দাও , আমি আশ্রয় চাচ্ছি সমস্ত মানুষের রব , সমস্ত মানুষের বাদশা ও সমস্ত মানুষের মাবুদের কাছে। এমন প্রত্যেটি সন্দেহ ও প্ররোচনা সৃষ্টিকারীর অনিষ্ট থেকে যা বার বার ঘুরে ফিরে আসে এবং মানুষের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করে ও তাদেরকে প্ররোচিত করে । তারা জিন শয়তানদের মধ্য থেকে হতে পারে , আবার মানুষ শয়তানদের মধ্য থেকেও হতে পারে। এটা হযরত মূসার ( আ) ঠিক সেই সময়ের কথার মতো যখন ফেরাউন ভরা দরবারে তাঁকে হত্যা করার সংকল্প প্রকাশ করেছিল। হযরত মূসা তখন বলেছিলেন :
“ আমি নিজের ও তোমাদের রবের আশ্রয় নিয়েছি এমন ধরনের প্রত্যেক দাম্ভিকের মোকাবেলায় যে হিসেবের দিনের প্রতি ঈমান রাখে না। ” ( আল মু’মিন , ২৭)
“ আর তোমরা আমর ওপর আক্রমণ করবে এ জন্য আমি নিজের ও তোমাদের রবের আশ্রয় নিয়েছি। ” ( আদ দুখান, ২০)
ফজিলত
হাদীস শরীফৈ প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর তা পড়ার গুরুত্ব এসেছে। এক বর্ণনায় এসেছে,
যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যা সূরা ইখলাস ও এই দুই সূরা পড়বে সে সকল বিপদ-আপদ থেকে নিরাপদ থাকবে। (জামে তিরমিজি, হাদীস : ২৯০৩; সুনানে আবু দাউদ,হাদীস : ১৫২৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ১৯২৬৬; সুনানে নাসাঈ ২/১৫৪; তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৯১৭)
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রাতে যখন ঘুমাতে যেতেন, তখন নিজের উভয় হাত এক সঙ্গে মিলাতেন। তারপর উভয় হাতে ফুঁক দিতেন এবং সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক, সূরা নাস পড়তেন। তারপর দেহের যতটুকু অংশ সম্ভব হাত বুলিয়ে নিতেন। তিনি মাথা, মুখমণ্ডল ও শরীরের সামনের অংশ থেকে শুরু করতেন। তিনি এরূপ তিনবার করতেন। -(সহি বুখারি ৫০১৭, সুনানে আবু দাউদ : ৫০৫৮, জামে তিরমিজি, হাদিস নং-৩৪০২)
হজরত উকবা ইবনে আমের জুহানি (রা.) থেকে বর্ণিত,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার ওপর কিছু আয়াত নাজিল হয়েছে, যা আমি এর মতো অনুরূপ দেখিনি। কুল আয়ুজু বি রাব্বিল ফালাক ও কুল আয়ুজু বি রাব্বিন নাস। -(জামে তিরমিজি, হাদিস নং-২৯০২)
নির্দেশনা
১. আশ্রয় কামনা একমাত্র আল্লাহর নিকট করা, তিনি এ মহাবিশ্বের প্রতিপালক ও আশ্রয়দাতা।
২. আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তার মধ্যে কিছু কিছু সৃষ্টিতে অনিষ্ট রয়েছে। কিংবা সেগুলোকে অবলম্বন করে কুচক্রীমহল শত্রুপক্ষকে ক্ষতি সাধন করতে পারে। এ জন্য এজাতীয় ক্ষতি থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা।
৩. এ সূরায় অন্ধকার রাত ও জাদুকারিণীদের অনিষ্টের কথা ফুটে উঠলেও এ ছাড়া আরো অনেক বিষয় রয়েছে, যার মাধ্যমে ক্ষতি সাধন করা হয়ে থাকে। সে সকল বিষয়ও এর অন্তর্ভুক্ত হবে। বস্তুত মানুষের ক্ষতি করা, কারো সাথে শত্রুতা পোষণ করা অনেক বড় পাপ। মানুষ মানুষের ক্ষতি করে থাকে প্রধানত তিনটি বিষয়ে- জানের ক্ষতি, ধন-সম্পদের ক্ষতি এবং ইজ্জত-আব্রু, মান-সম্মানের ক্ষতি সাধন। এই তিন ধরনের ক্ষতি থেকে নিরাপদ থাকার জন্য আল্লাহর কাছে আশ্রয়ের পদ্ধতি এ সূরায় শিক্ষা দেওয়া হয়েছে । হাদীসে রাসূল স. বলেছেন,
‘প্রকৃত মুসলমান সে ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ থেকে অন্যরা নিরাপদ থাকে।’ অর্থাৎ তার মাধ্যমে কেউ কোনোরূপ ক্ষতি বা অনিষ্টের শিকার হয় না। (সহীহ বুখারী-১০, সহীহ মুসলিম-৪০)
৪. হিংসা অত্যন্ত অপছন্দনীয় ও নিন্দনীয় কাজ। হিংসা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। হিংসুকের হিংসা কেবল তাকেই পোড়ায় না বরং যাবতীয় পুণ্যকেও ভস্ম করে দেয়।
৫. শয়তান দৃশ্যমান নয়, মনুষ্য চোখে তাকে দেখা না গেলেও সে বিদ্যমান ও মানুষের শত্রু তা সত্য। সে মানুষকে বিপথগামী করার ক্ষমতা রাখে। এক হাদীসে এসেছে, ‘নিশ্চয়ই শয়তান বলেছে, হে রব! আমি তোমার ইজ্জত-সম্মানের কসম করে বলছি, আমি তোমার বান্দাদেরকে যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের শরীরে রূহ থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত বিপথগামী করব। আল্লাহ বলেছেন,
আমি আমার ইজ্জত ও মহত্ত্বের শপথ করে বলছি, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তাদেরকে ক্ষমা করতে থাকব।’ (মুসনাদে আবী ইয়ালা-২/৪৫৮, হা. ১৩৬৯, মুসতাদরাকে হাকেম-৪/২৯০, হা. ৭৬৭২ সহীহ)
৬. শয়তানের অস্তিত্ব সত্য। সে মানুষকে আড়ালে থেকে ধোঁকা দেয়, মনে কুমন্ত্রণা দেয় । কতিপয় মানুষ এমন রয়েছে, যাদের মাঝে শয়তানী কূটচাল বিদ্যমান। তারা সরল-সত্য পথ থেকে বিচ্যুত । এরা মানুষরূপী শয়তান। তারাও মানুষদের কুমন্ত্রণা দেয় । জিন শয়তান এবং মানুষ শয়তানের অনিষ্ট থেকে বাঁচার উপায় হলো আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা।
উল্লেখ্য যে, আপন আপন ভাষায় আল্লাহর কাছে শয়তান ও অনিষ্টকারী মানুষ এবং অনিষ্টকারী জীবজন্তু থেকে আশ্রয় চাওয়া যায়। আউযুবিল্লাহ পড়ে অথবা রাসূলুল্লাহ স. থেকে বর্ণিত আশ্রয় প্রার্থনা করা সম্পর্কিত কোনো দোয়া পড়ে আশ্রয় চাওয়া যায়। এ ছাড়া সূরা ফালাক্ব ও নাস ইত্যাদি পড়ত আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া যায়।
সংগৃহীত