নাম ও পরিচয়
হজরত শীষ (আ:) হজরত হাবিল এর মৃত্যুর পাঁচ বছর পরে জন্মগ্রহণ করেন। হাবীলের ইন্তেকালের পর হজরত আদম (আ:) ও হজরত হাওয়া (আ:) পুত্র শোকে শোকাহত ও মর্মাহত ছিলেন। আল্লাহতায়ালা তাদের দুঃখ-চিন্তা দূর করার লক্ষ্যে তাদেরকে হজরত শীষ (আ:) এর মতো সুন্দর সন্তান দান করেছেন। শীষ শব্দের অর্থ আল্লাহর দান । যখন তিনি জন্ম লাভ করেন, তখন হজরত জিব্রাইল (আ:) হজরত হাওয়া (আ:) কে বললেন, এই বাচ্চাটি হাবীলের পরিবর্তে আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার জন্য উপহারস্বরূপ।
হজরত শীষ (আ:) এর জন্মের সময় হজরত আদম (আ:) এর বয়স হয়েছিল ২৩৫ বছর। হজরত হাওয়া (আ:) এর গর্ভে প্রতিবার এক ছেলে ও এক মেয়ে এভাবে একজোড়া সন্তান জন্ম লাভ করত। কিন্তু হজরত শীষ (আ:) এককভাবে জন্ম লাভ করেন। এটি একমাত্র নবী করীম (সা:) এর সম্মানার্থেই ছিল। হজরত শীষ (আ:) জন্মের পরে তার দুচোখের মাঝখানে হজরত আদম (আ:) হজরত মুহাম্মদ (সা:) এর নূর মোবারক দেখেছিলেন।
চরিত্র
হজরত আদম (আ:) এর সন্তানদের মধ্যে হজরত শীষ (আ:) ছিলেন জ্ঞানে-গুণে, শিক্ষা-দীক্ষায়, এবাদত-বন্দেগী এবং ধার্মিকতায় সবার শ্রেষ্ঠ। তাকেই হজরত আদম (আ:) নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান। অন্যান্য সকল বংশধরকে একত্রিত করে এই মর্মে নসিহত করে যান যে, তারা যেন সকলে হজরত শীষ (আ:) এর আদেশ মেনে চলে। হজরত শীষ (আ:) কে আল্লাহতায়ালা নবুয়ত ও আসমানি গ্রন্থও দান করেছেন।
হজরত আবু জর গিফারী সূত্রে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহতায়ালা আম্বিয়া কেরামগণের ওপর মোট একশত চারখানা সহিফা (আসমানি ঐশীগ্রন্থ) নাজিল করেছেন। তন্মধ্যে পঞ্চাশ খানা হজরত শীষ (আ:) এর ওপর নাজিল করেছেন। (ইবনে আসাকির, খন্ড-২৩, পৃষ্ঠা ২৭৩)
এবাদত-বন্দেগী
হজরত শীষ (আ:) নেককার, পরহেজগার, সৎ, আবেদ ও জাহেদ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সর্বদা দুরুদ ও জিকির নিয়ে মশগুল থাকতেন। অত্যন্ত নরম ও ভদ্র স্বভাবের লোক ছিলেন। দুনিয়ার আরাম-আয়েশ থেকে সর্বদা বিমুখ থাকতেন। একাকীত্ব পছন্দ করতেন। আল্লাহর হক, বান্দার হক এবং বিশেষ করে পিতা মাতার হক ও সেবার প্রতি অতি আগ্রহী ছিলেন।
আল্লাহতায়ালা তাঁকে দিবারাত্রি সময়ের জ্ঞান দান করেছিলেন। সর্বদা মক্কা মোকাররমায় অবস্থান করতেন এবং আজীবন হজ ও ওমরা করেছেন। তিনি হজরত আদম (আ:) এবং তাঁর ওপর নাজিলকৃত সহীফা সমূহ একত্রিত এবং সুসজ্জিত করেছেন আর সেগুলো মতে আমল করতেন। বাইতুল্লাহর নির্মাণ করেছেন মাটি ও পাথর দ্বারা। (তারিখুল কামিল, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৫৪)
হজরত আদম (আ:) এর নসিহত
হজরত আদম (আ:) স্বীয় পুত্র হজরত শীষ (আ:) কে বলেছিলেন, হে আমার প্রিয় পুত্র! তুমি আমার পর আমার খলিফা নিযুক্ত হবে। তাকওয়াকে নিজের ওপর আবশ্যক করে নেবে। যখন আল্লাহর জিকির করবে তখন সাথে মুহাম্মদ (সা:) এরও জিকির করবে। আমি তাঁর নাম মোবারক আরশের পায়ায় লিখিত দেখেছি। তখন আমি ছিলাম রুহ ও মাটির মধ্যে। আমি আসমানের চতুর্দিকে ঘুরে দেখেছি। আমি সেখানে প্রত্যেক জায়গায় ইসমে মুহাম্মদ লিখিত দেখেছি। এই নাম মোবারক আমি লিখিত দেখেছি তুবা নামক বৃক্ষে, সিদরাতুল মুনতাহা নামক বৃক্ষে, নূরানী পর্দা সমূহের পাশে এবং ফেরেশতাদের দুচোখের মধ্যখানে। তাঁর জিকির বেশি পরিমাণে করবে। ফেরেশতারা প্রতি মুহূর্তে তাঁর জিকির করতেছে। (ইবনে আসাকির, খন্ড-২৩, পৃষ্ঠা-২৮১)
দাওয়াত ও তাবলীগ
নুওয়াত প্রাপ্তির পর হযরত শীছ (আ) নিজের ও কাবীলের বংশধরদের মধ্যে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ শুরু করেন। তিনি তাহাদেরকে সত্য পথ প্রদর্শন করেন এবং নেক কাজের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। এই সময় লোকজন দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া যায়। একদল তাহার অনুসরণ ও আনুগত্য করে এবং অপর দল কাবীলের বংশধরদের আনুগত্য করে। কাবীলের বংশধরদের কিছু অংশ শীছ (আ)-এর দাওয়াতে সৎপথ প্রাপ্ত হয়, কিন্তু অন্যরা অবাধ্যতার উপর অটল থাকে (দা, মা. ই., ১১, ৮৫১)।
তাহারা আল্লাহকে ছাড়িয়া অগ্নিপূজা করিত যাহা শুরু হইয়াছিল কাবীলের জীবদ্দশাতেই। হাবীলকে হত্যার পর কাবীল ভয়ে ইয়ামান চলিয়া যায়। ইবলীস সেখানে গমন করিয়া তাহাকে বলে যে, অগ্নি হাবীলের কুরবানী এইজন্য কবুল ও গ্রাস করিয়াছিল যে, সে অগ্নির সেবা ও উপাসনা করিত। তাই তুমি তোমার ও তোমার পরবর্তী বংশের জন্য একখানি গৃহ নির্মাণ করিয়া তথায় অগ্নি স্থাপন কর। ইহা শুনিয়া কাবীল ঐরূপ গৃহ নির্মাণ করিয়া তথায় অগ্নি স্থাপন করিল এবং উহার উপাসনা করিতে লাগিল। সেই হইতে অগ্নিপূজা শুরু হইয়াছিল (আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৪৮)।
শীছ (আ)-এর সময়েও কাবীলের কতক বংশধর অগ্নিপূজায় রত ছিল। আর যাহারা শীছ (আ)-এর আনুগত্য করিয়াছিল পরবর্তীতে শীছ (আ)-এর ইনতিকালের পর তাহারাও পথভ্রষ্ট হইয়া যায়। এই কওমকেই সঠিক পথের সন্ধান দেওয়ার জন্য শীছ (আ)-এর অধস্তন ৫ম পুরুষ আখনূখ তথা ইদরীস (আ)-কে নবীরূপে প্রেরণ করা হয় (আনওয়ারে আম্বিয়া, পৃ. ১১)।
হযরত শীছ (আ)-এর বহু জ্ঞানগর্ভ ও মূল্যবান উপদেশ বর্ণিত রহিয়াছে। তিনি বলিতেন,
“আল্লাহকে সর্বদা স্মরণ করিবে। ন্যায়-অন্যায় বিচার করিয়া চলিবে। পিতা-মাতাকে সম্মান করিবে। তাহাদের সেবা-শুশ্রূষা করিবে। ভ্রাতৃত্বভাব রক্ষা করিবে। রিপুর বশীভূত হইয়া ক্রোধকে প্রশ্রয় দিবে না। অভাবগ্রস্ত ও দীন-দুঃখীকে মুক্ত হস্তে দান করিবে। সদয় ব্যবহার করিবে। পাপকার্য হইতে বিরত থাকিবে। বিপদাপদ, বিপর্যয় ও দুর্যোগে ধৈর্য ধারণ করিবে। আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল হইবে। আল্লাহর করুণার জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিবে”
(কাজী এ. এফ. মফিজ উদ্দীন আহমদ, কাছাছুল কুরআন, পৃ. ৭৭-৭৮)।
বাসস্থান
শীছ (আ) পিতার প্রিয়তম পুত্র ছিলেন। তাই তিনি সর্বদা আদম (আ)-এর সান্নিধ্যে থাকিয়া তাঁহার খিদমত করেন বলিয়া প্রমাণ পাওয়া যায়। একদা হযরত আদম (আ)-এর অসুখের সময় জান্নাতের তৈল ও যায়তুন ফল খাওয়ার জন্য তাহার বাসনা জাগিল। তিনি স্বীয় পুত্র শীছকে সায়না পর্বতে আল্লাহর নিকট হইতে তাহা চাহিয়া আনিবার জন্য প্রেরণ করিলেন। সেখানে আল্লাহ তাঁহাকে বলিলেন, তোমার পাত্র আগাইয়া ধর। অতঃপর মুহূর্তের মধ্যে উহা আদম (আ)-এর কাঙখিত জিনিসে পূর্ণ হইয়া গেল। অতঃপর আদম (আ) নিজের শরীরে উক্ত তৈল মালিশ করিলেন এবং কয়েকটি যায়তুন ফল খাইলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সুস্থ হইয়া গেলেন। এই ঘটনাই প্রমাণ করে যে, শীহ (আ) স্বীয় পিতা আদম (আ)-এর সান্নিধ্যে থাকিতেন। আর আদম (আ) মক্কা শরীফে বসবাস করেন, সেখানেই ইনতিকাল করেন এবং আবু কুবায়স পর্বতের পাদদেশে তাঁহাকে দাফন করা হয় (পূ. এ.; ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ৯৮)।
আকৃতি-প্রকৃতি
দৈহিক অবয়ব ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়া তিনি ছিলেন অবিকল স্বীয় পিতা আদম (আ)-এর ন্যায় (দা. মা. ই., ১১খ, ৮৫১)। তবে আদম (আ) ছিলেন শশ্রুবিহীন, আর তিনি ছিলেন শত্রুমণ্ডিত (পূ. এ., পৃ. ৮৫০)।
শীষ (আ:) এর বিবাহ
৯৬০ বৎসর বয়সে হজরত আদম (আঃ) অসুস্থ হয়ে পড়েন। পীড়িত অবস্থায় তিনি ফলমূল খাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। পুত্রগন ফলমূল সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন জায়গায় চলে গেলে, শুধুমাত্র শীষ (আঃ) পিতার সেবা যত্নের জন্য পাশে ছিলেন। অনান্য পুত্রদের ফল আনতে দেরী দেখে হজরত আদম (আঃ) পুত্র শীষকে বললেন ”তুমি অমুক পাহাড়ে গিয়ে দোয়া কর, তা হলে তোমার দোয়ার বরকতে আল্লাহ পাক আমার জন্য ফলমূল পাঠিয়ে দেবেন”।
উত্তরে শীষ (আঃ) বললেন “হে পিতা আপনি দোয়া করলে আল্লাহ আপনার দোয়া কবুল করবেন এবং ফল পাঠিয়ে দেবেন”। আদম (আঃ) বললেন “গন্ধম খাওয়ার কারনে আমি ফলের জন্য আল্লাহর দরবারে হাত তুলতে লজ্জাবোধ করছি “। পিতার কথামত শীষ (আঃ) আল্লাহর দরবারে হাত তুলে দোয়া করলেন। দোয়া শেষে দেখতে পেলেন হজরত জিবরাইল (আঃ) এর সাথে মুখোশ পড়া একজন হুর রেকাবী ভর্তি ফলমূল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আদম (আঃ) বললেন “হে জিবরাইল এই হুরটি কে?।
জিবরাইল (আঃ) বললেন ” আল্লাহ পাক জান্নাত থেকে এই হুরকে পাঠিয়েছেন শীষ (আঃ) এর স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করার জন্য, কেননা শীষ ব্যতিত আপনার সকল সন্তানই জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি হয়েছে”। তখন আদম (আঃ) বেহেশতের হুরের সাথে শীষ (আঃ)’র বিয়ে সম্পূর্ন করে দিলেন।
হজরত শীষ (আঃ) এর পুত্রগন আরবের জেদ্দায় বসতি গড়ে তুলেন। হজরত শীষের বংশ থেকেই হজরত ইবরাহিম (আঃ) জন্ম গ্রহন করেন। আমাদের শেষ নবী হজরত মোহাম্মদ (সঃ) হজরত ইবরাহিম (আঃ) পুত্র ইসমাইল (আঃ) এর বংশধর। হজরত আদম (আঃ)এর মৃত্যুর পর হজরত জিবরাইল (আঃ) জান্নাত থেকে মূল্যবান কাপড়, সুগন্ধিদ্রব্য নিয়ে এসে হজরত শীষ (আঃ) কে গোসল, দাফন ও কাফনের পদ্ধতি বলে দিলে, জিবরাইল (আঃ) এর নির্দেশ মত শীষ (আঃ) তা সম্পূর্ন করেন।
সন্তান-সন্ততি
বাইবেলের বর্ণনামতে শীছ (আ)-এর বয়স ১০৫ (এক শত পাঁচ) বৎসর কালে তাঁহার পুত্র আনূশ জন্মগ্রহণ করে। আনুশ ছাড়াও তাঁহার আরও বেশ কয়েকজন পুত্র-কন্যা ছিল (ইব্ন কুতায়বা, আল-মাআরিফ, পৃ. ১৩)। কিন্তু ইতিহাস ও সীরাত গ্রন্থসমূহে তাহাদের নাম-পরিচয় পাওয়া যায় না। পরবর্তী কালের সকল মানুষ শীছ (আ)-এরই বংশধর। কারণ আদম (আ)-এর দ্বিতীয় পুত্র হাবীল-এর অকাল শাহাদাত লাভের কারণে তাহার কোনও সন্তান-সন্ততি ছিল না। আর কাবীলের বংশধর সকলেই কাফির হওয়ার ফলে হযরত নূহ (আ)-এর মহাপ্লাবনে সকলেই ডুবিয়া মারা যায় (ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১খ, ৯৮)
মৃত্যু
ইঞ্জিলের বর্ণনা মতে তাঁর বয়স একশত পাঁচ বছর হলে তখন তাঁর প্রথম সন্তান আনূশ জন্মগ্রহণ করেন। হজরত শীষ (আ:) ইন্তেকালের নিকটবর্তী হলে তিনি আনূশকে নসিহত করেন এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেছেন। তবে হজরত শীষ (আ:) এর ছেলে আনূশ নবী ছিলেন না। হজরত শীষ (আ:) ৯১২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন এবং তাঁর যোগ্য পুত্র তাঁকে গোসল দিয়ে কাফন পরায়ে জবলে আবু কুবাইসে দাফন করেন। আবু কুবায়স পর্বতের গুহায় স্বীয় পিতা-মাতার পাশেই তাকে দাফন করা হয়।
বর্ণিত আছে যে, হজরত নুহ (আঃ) এর মহা প্লাবনের সময় আদম (আঃ) মৃতদেহ কবর থেকে উঠিয়ে একটি বাক্সে ভরে জাহাজে উঠিয়ে নেন। প্লাবন শেষ হলে পুনরায় তা যথাস্থানে দাফন করা হয়। শীষ (আঃ) এর পুত্রগণ আরবের জেদ্দায় বসতি স্থাপণ করেন। স্বামীর মৃত্যুতে বিবি হাওয়া (আঃ) মানসিক ভাবে দূর্বল হয়ে পড়েন। পুত্র শীষ (আঃ) কে সঙ্গে নিয়ে তিনি তৎকালীন বায়তুল মামুর তাওয়াফ করার জন্য মক্কায় আসেন। এরপর তিনি জেদ্দায় পুত্র নাতি নাতনীদের সাথে বসবাস শুরু করেন।
আদম (আঃ) এর মৃত্যুর এক বৎসর পর বিবি হাওয়া (আঃ) ইন্তেকাল করেন। তাকে জেদ্দাতেই দাফন করা হয়। হযরত শীষ (আঃ) এর এবং তাঁর হুর স্ত্রীর কবর ভারতের অযোদ্ধার ফাইযপুরে অবস্থিত। যেহেতু হুরদের মৃত্যু নেই তাই উনার স্ত্রী জীবিত আছেন এখনো। তবে উনার পার্থিব কবর রয়েছে হযরত শীষ (আঃ) এর কবরের পাশেই।
সংগৃহীত