মুহাররমের ১০ তারিখ পবিত্র আশুরা
আরবি সনের প্রথম মাস মুহাররম। মুহাররমের ১০ তারিখ পবিত্র আশুরা। এই দিন বছরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিন। পাপ মুক্তি ও ক্ষমার বার্তা নিয়ে আসে আশুরা। আশুরার রোজায় রয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্য ও ফজিলত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী যে এই রোজার ওসিলায় আল্লাহ তাআলা রোজাদারের বিগত এক বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-১১৬২)
মহররম মাসের ১০ তারিখ ‘আশুরা’ উপলক্ষে আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রোজা রেখেছেন এবং সাহাবিদেরও রোজা রাখতে বলেছেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হিজরতের পর মদিনার ইহুদিদের আশুরার দিন রোজা রাখতে দেখে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তারা বলল, এটি একটি উত্তম দিন যেদিন আল্লাহ মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের মুক্তি দিয়েছেন। তাই মুসা (আ.) এ দিন রোজা রাখতেন। তখন আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘আমি তোমাদের চেয়েও মুসার (আ.) অধিক নিকটবর্তী।’ এরপর তিনি এ দিন রোজা রাখেন, অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দেন। (সহিহ মুসলিম: ২৫৪৮)
রমজানের পর সবচেয়ে ফজিলতের রোজা হলো আশুরার রোজা। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ফরজ ছিল। এখন তা নফল। তবে ফজিলতের দিক থেকে এই রোজা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আমি নবীজিকে রমজান ও আশুরার মতো গুরুত্ব দিয়ে অন্য কোনো রোজা রাখতে দেখিনি। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১/২১৮)
কিছু আমল আছে যেগুলো নবীজি কখনো ছাড়েননি। সেই আমলগুলোর একটি হলো আশুরার রোজা। হজরত হাফসা (রা.) বলেন, নবীজি কখনো চারটি আমল ছাড়তেন না। আশুরার রোজা, জিলহজের প্রথম দশকের রোজা, প্রতিমাসের তিনটি রোজা এবং ফজরের আগের দুই রাকাত সুন্নত নামাজ। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২৬৩৩৯)
আশুরার রোজা সম্পর্কে নবীজি বলেন,
রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হলো মুহাররমের রোজা। আর ফরজ নামাজের পরে সর্বোত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদের নামাজ। (সহিহ মুসলিম ১/৩৫৮)
এক ব্যক্তি হজরত আলীর (রা.) কাছে জানতে চাইলেন যে, রমজানের পর আর কোন মাসে আপনি রোজা রাখার আদেশ করেন? হজরত আলী (রা.) বললেন, আমার সামনে একজন সাহাবী প্রিয় নবীজিকে এই প্রশ্নই করেছিলেন। তখন নবীজি বলেছিলেন
‘রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তবে মুহাররম মাসে রাখ। কারণ এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন। (জামে তিরমিজি, হাদিস: ১/১৫৭)
আশুরার রোজা কয়টি?
নবীজি ইরশাদ করেন, তোমরা আশুরার দিন এবং আশুরার আগের দিন কিংবা পরের দিন আরো একটি রোজা রাখো । অর্থাৎ আশুরার রোজা দুইটি। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং-২১৫৪)
আশুরার দিন রোজা রাখলে আল্লাহ তাআলা এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেন। আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,
আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, এ রোজার কারণে আল্লাহ তাআলা পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন। (সহিহ মুসলিম: ২৬১৭)
ইহুদিরা আশুরা উপলক্ষে এক দিন রোজা রাখতো। আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মুসলমানদের নির্দেশ দেন আশুরার দিনটির আগে বা পরে আরও এক দিন মিলিয়ে দুই দিন রোজা রাখতে যেন মুসলমানদের আমল ইহুদিদের আমলের সাথে পুরোপুরি মিলে না যায়। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,
তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখ এবং তাতে ইহুদিদের বিরোধিতা কর, আশুরার আগে একদিন বা পরে একদিন রোজা রাখো। (মুসনাদে আহমদ: ২১৫৫)
পবিত্র আশুরার রোজা রাখা মুসলিমদের জন্য গুরুত্বপর্ণ।
আশুরার দিনে রোজা রাখার পাশাপাশি নিয়মিত নামাজ আদায়, বেশি বেশি তওবা-ইস্তিগফার করা এবং সৎ কাজ করতে হবে। এসব কাজের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব। নিচে পবিত্র আশুরার রোজা রাখাসহ অন্যান্য করণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো
১. রোজা রাখা: বিভিন্ন হাদিসে পবিত্র আশুরার রোজার ফজিলত রয়েছে। হজরত আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মহান আল্লাহর কাছে আমি আশা পোষণ করি, তিনি আশুরার রোজার মাধ্যমে আগের এক বছরের পাপ ক্ষমা করে দেবেন। (তিরমিজি : ৭৫২)
২. ইবাদত ও দোয়া করা, নামাজ আদায় : পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি নফল নামাজ আদায় করা। কোরআন তেলাওয়াত : বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করা। – দোয়া : নিজের এবং অন্য মুসলমানদের জন্য কল্যাণ কামনা করে দোয়া করা।
৩. তওবা ও ইস্তিগফার: নিজের গুনাহের জন্য তওবা করা এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। আশুরার দিন তওবা কবুলের মোক্ষম সময়। এদিনে তওবা কবুল হওয়া, নিরাপত্তা এবং অদৃশ্য সাহায্য লাভ করার কথাও রয়েছে। এ জন্য এ সময়ে এমন সব আমলের প্রতি মনোনিবেশ করা উচিত, যাতে মহান আল্লাহর রহমত বান্দার দিকে আরও বেশি ধাবিত হয়।
৪. সৎ কাজ করা ও সহায়তা করা এবং সদয় আচরণ করা।
– সৎ কাজ : যে কোনো সৎ কাজ করা, যেমন মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করা, মিথ্যা ও অন্যায় থেকে বিরত থাকা।
– গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করা: আশুরার দিনে দান-খয়রাত করা এবং গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করা।
– আত্মীয়স্বজনের সাথে সম্পর্ক রক্ষা : আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের প্রতি সদয় আচরণ করা।
৫. শিক্ষামূলক কার্যক্রম – শিক্ষা গ্রহণ : আশুরার দিনের তাৎপর্য এবং ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা।
– পরিবারের সাথে আলোচনা : পরিবারের সদস্যদের সাথে আশুরার দিনের তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করা এবং তাদের এই দিনটি গুরুত্বের সাথে পালনের জন্য উৎসাহিত করা।
৬. শোক পালন – কারবালার শহীদদের স্মরণ : হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) এবং তার সঙ্গীদের কারবালার ময়দানে শাহাদাত বরণের ঘটনা স্মরণ করা। তাদের ত্যাগের গুরুত্ব বোঝা এবং অনুভব করতে পারা।
আশুরার রোজায় বিশেষ দুইটি পুরস্কার
একবার এক ব্যক্তি আলী (রা.)-কে প্রশ্ন করেছিল যে, রমজানের পর আর কোনো মাস আছে; যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন? তখন তিনি বললেন, এই প্রশ্ন আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর নিকট জনৈক সাহাবি করেছিলেন, তখন আমি তার খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন,
‘রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তবে মহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন। ’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ১/১৫৭)
যে কারণে আশুরায় দুই রোজা
আশুরার রোজা সম্পর্কে এক হাদিসে আছে, ‘তোমরা আশুরার রোজা রাখ এবং ইহুদিদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে— আশুরার আগে বা পরে আরও একদিন রোজা রাখ। ’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১/২৪১)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি, তাহলে ৯ তারিখেও অবশ্যই রোজা রাখব। ’ (সহিহ মুসলিম : ১/৩৫৯)
আল্লাহ তাআলা আমাদের আশুরার রোজা রাখার এবং সঠিকভাবে ইসলাম মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।
সংগৃহীত