শোয়াইব নামের অর্থ আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহপ্রাপ্ত। তিনি ইবরাহিম আ:-এর বংশোদ্ভূত নবী। শোয়াইব আ:-এর পিতা ফাহমিল, ফাহমিলের পিতা এছজার এবং তার পিতা মাদইয়ান। ইবরাহিম আ:-এর পুত্র মাদইয়ানের নামে জনপদটি পরিচিত হয়েছে। হজরত শোয়াইব আ: এই জনপদে প্রেরিত হয়েছিলেন। ইনি হজরত মূসা আ:-এর শশুর ছিলেন। কওমে লুতের ধ্বংসের অনতিকাল পরে কওমে মাদইয়ানের প্রতি তিনি প্রেরিত হন। চমৎকার বাগ্মিতার কারণে তিনি নবীদের মধ্যে সেরা বাগ্মী নামে খ্যাত ছিলেন। কোথাও কোথাও ‘আছহাবুল আইকাহ’ বলা হয়েছে যার অর্থ জঙ্গলের বাসিন্দারা।

মাদইয়ান ছিলেন হাজেরা ও সারাহর মৃত্যুর পর হজরত ইবরাহিম আ: আরব বংশোদ্ভূত কেনআনি স্ত্রী ইয়াক্কতিনের ছয়টি পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র। আল্লাহর গজবে ধ্বংসপ্রাপ্ত ছয়টি জাতির মধ্যে পঞ্চম হলো আহলে মাদইয়ান। মাদইয়ান লুত সাগরের নিকটবর্তী সিরিয়া ও হিজাজের সীমান্তবর্তী একটি জনপদের নাম। যা অদ্যাবধি পূর্ব জর্দানের সামুদ্রিক বন্দর মোআনের অদূরে বিদ্যমান রয়েছে।

কওমে শোয়াইবের ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থা :

কওমে শোয়াইব আল্লাহর হক তারা নষ্ট করেছিল। আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে তারা কুফুরি, শিরক ও সৃষ্টিপূজায় লিপ্ত ছিল। তারা মাপ ও ওজনে কম দিয়ে বান্দার হক নষ্ট করেছিল। মানুষের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করত। পৃথিবীতে তারা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করেছিল। তারা সংখ্যায় কম ছিল ও দরিদ্র ছিল। আল্লাহ সংখ্যা বৃদ্ধিসহ সচ্ছলতা দান করলেও তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করত না।

হজরত শোয়াইব আ:-এর দাওয়াত:

‘আমি মাদইয়ানের প্রতি তাদের ভাই শোয়াইবকে প্রেরণ করেছিলাম। সে তাদের বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ এসে গেছে। অতএব তোমরা মাপ ও ওজন পূর্ণ করো। মানুষকে তাদের মালামাল কম দিয়ো না। ভূপৃষ্ঠে সংস্কার সাধনের পর তোমরা সেখানে অনর্থ সৃষ্টি করো না। এটিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’(সূরা আরাফ-৮৫)।

‘তোমরা পথেঘাটে এ কারণে বসে থেকো না যে, ঈমানদারদের হুমকি দেবে, আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করবে ও তাতে বক্রতা অনুসন্ধান করবে। স্মরণ করো যখন তোমরা সংখ্যায় অল্প ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদেরকে আধিক্য দান করেছেন এবং লক্ষ করো কিরূপ অশুভ পরিণতি হয়েছে অনর্থকারীদের’ (সূরা আরাফ-৮৬)।

শোয়াইব আ:-এর দাওয়াতের প্রতিক্রিয়া :

সব নবীর সাথে ইতঃপূর্বে যেমন আচরণ করা হয়েছিল, শোয়াইব আ:-এর সাথে তার ব্যতিক্রম হয়নি। তাদের কথা এভাবে এসেছে,

‘তোমার সালাত কি তোমাকে এ কথা শেখায় যে, আমরা আমাদের ওইসব উপাস্যের পূজা ছেড়ে দেই, আমাদের পূর্বপুরুষরা যুগ যুগ ধরে যেসবের পূজা করে আসছে? আর আমাদের ধন-সম্পদে ইচ্ছামতো আমরা যা কিছু করে থাকি, তা পরিত্যাগ করি? তুমি তো একজন সহনশীল ও সৎ ব্যক্তি’ (সূরা হুদ-৮৭)।

দ্বিতীয়ত : তারা ইবাদত ও মুআমালাতকে পরস্পর প্রভাবমুক্ত ভেবেছিল। আল-কুরআনে বলা হয়েছে,

‘তার সম্প্রদায়ের কিছু নেতৃস্থানীয় লোক, যারা অহঙ্কার করছিল তারা বলল, হে শোয়াইব! আমরা অবশ্যই তোমাকে এবং তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে আমাদের জনপদ থেকে বের করে দেবো, অথবা তোমাদের অবশ্যই আমাদের জাতিতে ফিরে আসতে হবে; সে বলল, যদি আমরা (তোমাদের দ্বীনকে) পছন্দ না-ও করি তাহলেও (কি তা মানতে হবে) (সূরা আরাফ-৮৮)।

মাদইয়ানের ওপরে আপতিত গজব :

‘হে আমাদের রব! আমাদের এবং আমাদের জাতির মাঝে তুমি সঠিক ফায়সালা করে দাও।, কারণ তুমিই হচ্ছো সর্বোত্তম ফায়সালাকারী।’ (সূরা আরাফ-৮৯)।

এরপর শোয়াইব তাদের কাছ থেকে সরে গেল, যাওয়ার সময় বলল, হে আমার জাতি, আমি তোমাদের কাছে আমার মালিকের বাণীসমূহ পৌঁছে দিয়েছিলাম, আমি আন্তরিকভাবেই তোমাদের কল্যাণ কামনা করেছিলাম। আমি কিভাবে এমন সব মানুষের জন্য আফসোস করব যারা স্বয়ং আল্লাহকেই অস্বীকার করে।’ (সূরা আরাফ-৯৩)।

‘অতঃপর একটা প্রচণ্ড ভূকম্পন এসে তাদের (এমনভাবে) আঘাত করল, দেখতে দেখতে সবাই তাদের নিজ নিজ ঘরেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল’ (সূরা আরাফ-৯১)।

‘যারা শোয়াইবকে অমান্য করল তারা যেমনভাবে ধ্বংস হয়ে গেল দেখে মনে হয়েছে, সেখানে কোনো দিন কেউ বসবাসই করেনি, বস্তুত যারা শোয়াইবকে অস্বীকার করেছে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত’ (সূরা আরাফ-৯২)।

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ :

‘আমি কোনো জনপদে নবী পাঠিয়েছি অথচ সেই জনপদের মানুষদের অভাব ও কষ্ট দিয়ে পাকড়াও (পরীক্ষা) করিনি, এমনটি কখনো হয়নি, আশা করা গিয়েছিল, তারা (আল্লাহ তায়ালার কাছে) বিনয়াবনত হবে’ (সূরা আরাফ-৯৪)।

কওমের নেতারা ধর্মীয় ও বৈষয়িক ভাগ করে নিয়ে জীবনের সব ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে প্রস্তুত নয়। আল্লাহর সাথে শিরক ও নৈতিক অধোপতনের কারণেই তারা আল্লাহর গজবে পতিত হয়েছিল।

ওজনে কম দিয়ে ধ্বংস হওয়া একটি জাতির গল্প!

মাদইয়ান সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরিত হয়েছেন হজরত শোয়াইব (আ.)। হজরত শোয়াইব (আ.) ছিলেন হজরত ইবরাহিম (আ.) এর তৃতীয় স্ত্রী কাতুরার ঘরের পুত্র মাদইয়ানের বংশধর। এ জন্য হজরত ইবরাহিম (আ.) এর এই বংশধরকে বনি কাতুরা বলা হয়। কোনো কোনো বর্ণনা মতে, হজরত শোয়াইব (আ.) হজরত সালেহ (আ.) এর বংশোদ্ভূত নবী ছিলেন। যেহেতু তিনি মাদইয়ান সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরিত হয়েছেন, তাই পরবর্তী সময়ে তার নামেই তার কওমের নাম হয়ে যায় কওমে শোয়াইব। বর্তমান সিরিয়ার মুয়ান নামক স্থানে সে কওমে শোয়াইবের বসবাস ছিল বলে জানা যায়। কোরআনে কারিমের কোথাও তাদের ‘আসহাবে মাদইয়ান’ ও ‘আহলে মাদইয়ান’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কোথাও ‘আসহাবে আইকা’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। আইকা অর্থ বনজঙ্গল। এ জায়গার মাটি অত্যন্ত উর্বর হওয়ায় সে স্থানে ফলফলাদিসহ বিভিন্ন ধরনের গাছ-গাছালি বেশি হতো। তাই কোরআনে কারিমে তাকে ‘আইকা’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে।

মাদইয়ানবাসী পার্থিব লোভ-লালসায় মত্ত হয়ে পাস্পরিক লেনদেনের সময় ওজনে কমবেশি করে মানুষের হক আত্মসাৎ করত। মহান আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে শরিক স্থাপন করত। গাছপালা ও মূর্তি পূজায় তারা লিপ্ত থাকত। লেনদেনের ক্ষত্রে দুর্নীতি, প্রতারণা, ছিনতাই, রাহাজানি ও মজুদদারির মতো জঘন্য অন্যায় তারা করত। এসব পাপে তারা এমনভাবে লিপ্ত ছিল যে, তারা কখনোই উপলব্ধি করত না, তারা অন্যায় করছে বা তারা যা করছে তা গর্হিত কাজ। বরং তারা অবাধ্যতা প্রদর্শন করতে পেরে আনন্দ বোধ করত। এভাবে তারা ভূপৃষ্ঠে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করত। তাদের কাছে পাঠানো হলো হজরত শোয়াইব (আ.)কে। হজরত শোয়াইব (আ.) সর্বপ্রথম তাদের তাওহিদের দাওয়াত দিলেন। বললেন,

‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করো, যিনি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই।’ (সুরা আরাফ : ৮৫)।

তাওহিদের দাওয়াত দেয়ার পরপরই হজরত শোয়াইব (আ.) তাদেরকে তাদের কুকর্ম ওজনে কম দেয়ার হীন মানসিকতাকে দূর করার দাওয়াত দিলেন। তিনি বলেন,

‘তোমরা পরিমাপে ও ওজনে কম দিও না। আজ আমি তোমাদের ভালো অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আমি তোমাদের ব্যাপারে পরিবেশ নষ্টকারী দ্বীনের আজাবের ভয় পাচ্ছি। হে আমার কওম! ন্যায়-নিষ্ঠার সঙ্গে ওজন পূর্ণরূপে করো। লোকদের জিনিসপত্রে কোনোরূপ ক্ষতি করো না। আর পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।’ (সুরা আরাফ : ৮৪-৮৫)।

‘মানুষের জিনিসপত্রে কোনোরূপ ক্ষতি করো না।’ এ কথা থেকে বোঝা যায়, ওজনে কম দেয়া যেমন হারাম, তেমনি হারাম অপরের অধিকারে হসত্মক্ষপ করা। হজরত শোয়াইব (আ.) তাদের আরও উপদেশ দিলেন, মানুষকে ভীতি প্রদর্শন করে তাদের সম্পদ গ্রহণ করার জন্য রাসত্মাঘাটে ওৎপেতে বসে থেকো না। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে,

‘আর তোমরা পথেঘাটে এই উদ্দেশ্যে বসে থেকো না যে, আল্লাহ তায়ালার বিশ্বাসীদের হুমকি দেবে, আল্লাহ তায়ালার পথে বাধা সৃষ্টি করবে এবং তাতে বক্রতা অনুসন্ধান করবে। স্মরণ করো যখন তোমরা সংখ্যায় ছিলে কম, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অধিক করেছেন এবং লক্ষ্য করো কিরূপ অশুভ পরিণতি হয়েছে ফিতনাকারীদের।’ (সূরা আরাফ, আয়াত নং : ৮৫)।

হজরত শোয়াইব (আ.) তাদের বিভিন্নভাবে নবীসুলভ সহনশীলতার সঙ্গে বুঝিয়েছেন। কিন্তু বিনিময়ে তিনি শুধু উপহাস-পরিহাসই পেয়েছেন। অবশেষে তারা যখন সীমা লঙ্ঘন করে ফেলল তখন আল্লাহ তায়ালার আজাব এসে গেল। প্রথমে কয়েকদিন তাদের অঞ্চলে ভীষণ গরম পড়ল। গোটা জাতি ছটফট করতে লাগল। অতঃপর কাছের একটি ময়দানের ওপর গাঢ় মেঘমালা দেখা গেল। ময়দানে ছায়া পড়ল। শীতল বাতাস বইতে লাগল। এলাকার সবাই সেই ময়দানে জমায়েত হলো। বলতে লাগল এই মেঘ আমাদের ওপর বৃষ্টি নাজিল করবে। যখন সবাই সেখানে সমবেত হলো, তখন মেঘমালা থেকে অগ্নিবৃষ্টি বর্ষিত হতে শুরু হলো। নিচের দিকে শুরু হলো ভূমিকম্প। ফলে সবাই সেখানে ধ্বংস হয়ে গেল। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে,

‘তাদের ভীষণ ভূমিকম্প পাকড়াও করল। ফলে তারা নিজেদের গৃহের অভ্যন্তরে উপুড় হয়ে পড়ে রইল।’ (সূরা আরাফ : ৯১)।

তাদের ওপর মোট তিন ধরনের আজাব অবতীর্ণ হয়েছিল।

  • এক. মেঘমালা থেকে অগ্নিবৃষ্টি বর্ষিত হয়,
  • দুই. এরপর বিকট শব্দ শোনা যায়,
  • তিন. সর্বশেষ ভূমিকম্প হয়।

এ প্রসঙ্গে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) বলেন, হজরত শোয়াইব (আ.) এর সম্প্রদায়ের ওপর প্রথমে এমন আজাব চাপিয়ে দেয়া হয়, যেন জাহান্নামের দরজা তাদের জন্য খুলে দেয়া হয়েছিল। ফলে তাদের শ্বাস রুদ্ধ হতে থাকে। তখন ছায়া তো দূরের কথা, পানিতেও তাদের শান্তি ছিল না। অতঃপর তারা অসহ্য গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ভূগর্ভস্থ কক্ষ প্রবেশ করে দেখল, সেখানে আরও বেশি গরম। তখন তারা অস্থির হয়ে ময়দানের দিকে ধাবিত হলো। সেখানে আল্লাহ তায়ালা একটি ঘন কালো মেঘ পাঠিয়ে দিলেন, যার নিচে শীতল বাতাস বইছিল। তারা সবাই গরমে দিগ্বিদিক জ্ঞানহারা হয়ে মেঘের নিচে এসে ভিড় করল। তখন মেঘমালা থেকে তাদের ওপর অগ্নিবৃষ্টি বর্ষিত হতে শুরু হলো এবং ভূমিকম্পও হলো। অপরদিকে বিকট গর্জনও তাদের পাকড়াও করল। ফলে তারা সবাই ভস্মস্তুপে পরিণত হলো।

হজরত শোয়াইব (আ.)-এর জীবনী থেকে আমাদের বড় শিক্ষণীয় হলো বেচাকেনায় ওজন ও পরিমাণে কম না দেওয়া, প্রতারণা করে পরের হক নষ্ট না করা। পরের হক নষ্ট করলে আমাদের ওপরও আল্লাহর আজাব পতিত হওয়া বিচিত্র নয়। আল্লাহ আমাদের বোঝার ও আমল করার তওফিক দান করুন। আমিন।

মক্কা থেকে সিরিয়া যাওয়ার পথে এসব ধ্বংসস্থল নযরে পড়ে। রাসুলুল্লাহ্‌ (সাঃ) যখন এসব স্থান অতিক্রম করতেন, তখন আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে পড়তেন এবং সওয়ারীকে দ্রুত হাকিয়ে নিয়ে স্থান অতিক্রম করতেন। আল্লাহ আমাদেরকে এই সমস্থ ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার তওফিক দান করুক । আমিন।

সংগৃহীত

Views: 318