প্রযুুক্তি আল্লাহর নেয়ামত। প্রযুক্তির কল্যাণে কত কঠিন ও দুঃসাধ্য কাজ আমরা মুহূর্তেই সমাধান করতে পারছি। মানুষের সামনে প্রতিনিয়ত উন্মুক্ত হচ্ছে মহাবিশ্বের অপার বিস্ময়। আল্লাহর সৃষ্টিকে জানার এবং তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার দারুণ সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। আল্লাহর দেওয়া জ্ঞানবুদ্ধির সঠিক ব্যবহারের ফলেই এসব সম্ভব হচ্ছে। তাই আল্লাহর নির্দেশিত পথে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা মুমিনের জন্য অপরিহার্য। অশ্লীলতা, প্রতারণা, সন্ত্রাস, যৌন হয়রানি সবই ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ। তাই প্রযুক্তির ব্যবহারে আমাদের হতে হবে শুদ্ধ ও নৈতিক। নিজে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরও করতে হবে সচেতন। নীতি-নৈতিকতার নির্দেশনা ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বময়। পৃথিবীতে যা কিছুই কল্যাণকর, তা গ্রহণ করার বৈধতা দেয় ইসলাম। প্রযুক্তিরও রয়েছে কল্যাণকর দিক। এই দিক থেকে উপকৃত হওয়া মুনিনের জন্য বৈধই নয়, অনেক ক্ষেত্রে জরুরিও। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন,
‘তোমাকে যা উপকৃত করবে সে ব্যাপারে তুমি ধাবিত হও এবং আল্লাহর সাহায্য কামনা করো। নিরাশ হয়ো না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৬৬৪)
প্রযুক্তির অকল্যাণের দিক মুমিন অবশ্যই এড়িয়ে চলবে। আল্লাহর ভয়, আনুগত্য ও জবাবদিহির কথা সবসময় স্মরণ রাখবে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজকের মুসলিমসমাজ প্রযুক্তির মাধ্যমে নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত।
প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার অপরাধও। পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা যুবসমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। প্রযুক্তির সব মাধ্যমেই যৌনতার ছড়াছড়ি। সব ধরনের অশ্লীলতা ইসলামে হারাম। আল্লাহতায়ালা বলেন,
‘যারা ঈমানদারদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার পছন্দ করে, তাদের জন্য ইহকাল ও পরকালে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।’ (সুরা নুর, আয়াত : ১৯)
অশ্লীলতার ব্যাপক প্রসার কেয়ামতের লক্ষণ। নগ্নতাকে সহজলভ্য করে পৃথিবীর ধ্বংস ত্বরান্বিত করা কোনো মুমিনের কাজ হতে পারে না। হাদিস শরিফে এসেছে,
‘কেয়ামতের আলামত হলো, একসময় কৃপণতা ও অশ্লীলতা প্রকাশ পাবে। খিয়ানতকারীকে আমানতদার মনে করা হবে। আমানতদারকে খিয়ানতকারী মনে করা হবে। নারীদের নতুন নতুন পোশাকের উদ্ভব ঘটবে, যেগুলো পরিধান করে নারীরা বস্ত্রাবৃত হয়েও নগ্ন থাকবে। নিকৃষ্ট লোকেরা অভিজাত লোকদের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে।’ (তাবরানি আওসাত, হাদিস : ৭৪৮৯)
প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিজিটাল জালিয়াতি ও লুটপাট হচ্ছে। মানুষ নানাভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছে। অনলাইন ব্যবসার নামে পাতা হচ্ছে ভয়ংকর ফাঁদ। এসব ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ। প্রতারক কখনো সত্যিকারের মুমিন হতে পারে না। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন,
‘যে প্রতারণা করে সে আমার দলভুক্ত নয়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১০২)
সাইবার বুলিয়িং প্রযুক্তির যুগে আরেক মারাত্মক অপরাধ। মানুষকে অপদস্থ করা, অসম্মান করা এবং তার গোপনীয়তা ফাঁস করা কঠিন গুনাহ। মানুষের সম্মান আল্লাহর কাছে বড়ই পবিত্র। বিদায় হজের ভাষণে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন,
‘তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ এবং তোমাদের সম্মান তোমাদের মধ্যে ঠিক তেমনি পবিত্র, যেমন তোমাদের আজকের এই দিন এই মাস এই শহর পবিত্র।’ (সুনানু ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩০৫৫)
ব্যক্তিগত গোপনীয়তা একজন ব্যক্তির সম্মানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। গোপনীয়তা লঙ্ঘন করার বিষয়টিকে অনধিকারচর্চা বিবেচনা করে কঠিনভাবে নিষিদ্ধ করেছে ইসলাম। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,
‘হে মুমিনরা, তোমরা নিজেদের ঘর ছাড়া অন্য ঘরে প্রবেশ করো না, যে পর্যন্ত আলাপ-পরিচয় না করো এবং গৃহবাসীদের সালাম না করো। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যাতে তোমরা স্মরণ রাখো।’ (সুরা নুর, আয়াত : ২৭)
একই সঙ্গে অন্যের ব্যক্তিগত গোপন বিষয় জানার চেষ্টাও ইসলামে অনধিকারচর্চা হিসেবে বিবেচিত। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,
‘হে মুমিনরা, তোমরা অধিক পরিমাণ ধারণা করা থেকে বেঁচে থেকো। নিশ্চয়ই বহু ধারণা গুনাহ। আর গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারো পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো এটাকে ঘৃণাই করো। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত : ১২)
সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আমরা যেকোনো বিষয়ে মতপ্রকাশের সুযোগ পাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে লাগামহীন হওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। যাচাই-বাছাই না করে তথ্য শেয়ার করা কঠিন অপরাধ। এটি মিথ্যাচারের শামিল। রাসুল (সা.) বলেন,
‘যা শুনবে তা-ই (যাচাই-বাছাই না করে) বলে দেওয়া মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫)
তাই প্রতিটি কথা যাচাই-বাছাই করে ভেবেচিন্তে লিখতে হবে। অন্যায়কে সমর্থন করা, অশালীন মন্তব্য করা ইত্যাদি থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। বান্দার সব কথা-কাজ আল্লাহর কাছে প্রতিনিয়ত রেকর্ড হচ্ছে। প্রতিটি কথার জন্যই আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন,
‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তার জন্য তৎপর প্রহরী তার কাছেই রয়েছে।’ (সুরা কাফ, আয়াত : ১৮)
এসব সাইবার অপরাধ থেকে বের হতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আল্লাহভীতি। অন্তরে আল্লাহর ভয় না থাকলে বদ্ধ রুমে বসে সব ধরনের অপরাধ করা সম্ভব। তাই আল্লাহর ভয় অন্তরে রাখতে হবে। আল্লাহকে ভয় করা মুমিনের জন্য আবশ্যক। রাসুল বলেন,
‘যখন যেভাবেই থাকো না কেন, আল্লাহতায়ালাকে ভয় করবে। আর মন্দ কাজ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে নেক কাজ করবে। কারণ, নেক কাজ মন্দকে মুছে ফেলে। আর মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে।’ (সুনানে তিরমিজি : ১৯৮৭)
প্রযুক্তির পৃথিবীকে সম্পূর্ণ কলুষতামুক্ত করতে আমাদের অবশ্যই বিজ্ঞানচর্চায় এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সন্তানদের বিজ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে সৃষ্টিজগত নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার তাগিদ দিয়েছেন। মানুষের কল্যাণে আবিষ্কৃত প্রতিটি বস্তু অবশ্যই সাদাকায়ে জারিয়া হিসেবে গণ্য হবে। ইসলামের প্রথম যুগে মুসলিমরা বিজ্ঞানচর্চায় এগিয়ে ছিলেন। আমাদেরও ইতিবাচক বিজ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করতে হবে।
প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে নিজেকে শুদ্ধ ও নৈতিক মানুষে পরিণত করতে হবে। ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে হবে মানুষের মাঝে। নৈতিকতার প্রসার ঘটাতে হবে। আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করতে হবে। কোরআন-হাদিসের বাণী ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বময়। এই আহ্বান জানিয়েই রাসুল (সা.) বলেন,
‘আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও পৌঁছে দাও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৪৬১)
‘বলে দিন, আমার প্রতিপালক তো হারাম করেছেন অশ্লীল কাজগুলো প্রকাশ্যে হোক বা গোপন এবং সর্বপ্রকার গুনাহ, অন্যায়ভাবে কারও প্রতি সীমা লঙ্ঘন, যে আল্লাহ সম্পর্কে কোনো প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি, এমন জিনিসকে আল্লাহর শরিক সাব্যস্তকরণ এবং আল্লাহ সম্পর্কে এমন কথা বলাকে যে সম্বন্ধে তোমাদের বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই।’ (সুরা আরাফ : ৩৩)
‘তোমরা প্রকাশ্য ও গোপন পাপ বর্জন করো, যারা পাপ করে, অচিরেই তাদের পাপের সমুচিত শাস্তি দেওয়া হবে।’ (সুরা আনআম : ১২০)
‘হে নবী! মুমিনদেরকে বলে দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এটিই তাদের জন্য উত্তম। তারা যা করে, আল্লাহ সে বিষয়ে অবগত।’ (সুরা নূর : ৩০)
‘এক ব্যক্তি লোকসমক্ষে জান্নাতবাসীদের মতো আমল করে, অথচ সে জাহান্নামি। আরেকজন ব্যক্তি লোকসমক্ষে জাহান্নামিদের অনুরূপ আমল করে, অথচ সে জান্নাতি’ (বুখারি : ২৯৩৫; মুসলিম : ৩২০)।