হাদিয়া আরবি শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে উপঢৌকন, উপহার ইত্যাদি। ভালোবাসা ও আন্তরিকতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও অন্যদের যে উপহার আদান প্রদান করা হয় তাকে হাদিয়া বলে। উপহার বিনিময় সামাজিক জীবনের একটি সাধারণ অনুষঙ্গ। উপহার প্রদানের মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। হাদিয়া বিনিময় একটি প্রশংসনীয় সুন্নত। নবীজি (সা.) অধিকাংশ সাহাবিকে হাদিয়া-উপহার দিতেন। সাহাবায়ে কেরামও নবীজিকে (সা.) উপহার দিতেন। তারা নিজেরাও পারস্পরিক উপহার আদান-প্রদান করতেন।

পারস্পরিক বন্ধন মজবুত করার জন্য উপহার আদান-প্রদান খুবই উত্তম কার্যকর পন্থা। অনেক সময় উপহার আদান-প্রদানের কারণে প্রিয়জন ও আত্মীয়স্বজনদের অসন্তুষ্টি কষ্ট খতম হয়ে যায়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন,

‘পরস্পর হাদিয়া দাও, মহব্বত বৃদ্ধি পাবে।’ (আল আদাবুল মুফরাদ : ৫৯৪)।

‘হাদিয়া দেওয়ার মাধ্যমে মহব্বত তৈরি হয় এবং ভ্রাতৃত্ব বজায় থাকে।’ (বিহারুল আনওয়ার : ৭৪/১৬৬)।

হাদিয়া যতই ক্ষুদ্র হোক, তাকে ঘৃণা করতে বা ছোট মনে করতে নবীজি (সা.) নিষেধ করেছেন। যদি তা উটের পায়ের ক্ষুরও হয় (তিরমিজি : ২১৩০)। হাদিয়া বিনিময়ের মাধ্যমে হিংসা বিদ্বেষ দূর হয়। যেমন রাসুল (সা.) বলেন,

‘তোমরা পরস্পরে হাদিয়া বিনিময় করো, এর দ্বারা অন্তরের সংকীর্ণতা ও হিংসা দূর হয়ে যায়।’ (মুসনাদে আহমদ : ৯২৫০)।

কিন্তু হাদিয়া দিয়ে কখনও প্রাপ্তির আশা করা বা হাদিয়া দিয়ে খোঁটা দেওয়া ঠিক নয়। হাদিয়া বিনিময় হবে সম্পূর্ণ আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির জন্য। আবার অনেকেই হাদিয়াকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। বিশেষ করে সমাজের গরিব শ্রেণির লোকজনের কাছ থেকে হাদিয়া এলে তা নিয়ে মাঝেমধ্যেই হাসিতামাশা করে এবং তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ফিরিয়ে দেয়। এগুলো একদম অনুচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

‘যাকে সুগন্ধি দান করা হয়, সে যেন তা ফিরিয়ে না দেয়। কেননা এটি হালকা জিনিস, কিন্তু সুগন্ধযুক্ত।’ (মুসলিম : ২২৫৩)।

আবার হাদিয়া ফিরিয়ে নেওয়াও জঘন্য কাজ। কারণ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

‘যে দান করে তা প্রত্যাহার করে নেয়, তার দৃষ্টান্ত এমন কুকুরের মতো, যে বমি করে ফের তা খেয়ে নেয়।’ (বোখারি : ২৫৮৯)।

হাদিয়াকে আমরা অনেক সময় ঘুষের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলি। কিন্তু হাদিয়া ও ঘুষের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। হাদিয়া স্বেচ্ছায়, সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রাখতে দিয়ে থাকে। এতে পার্থিব কোনো উদ্দেশ্য থাকে না। কোনো বিশেষ স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে হাদিয়া দেওয়া হয় না। কিন্তু ঘুষ তার ঠিক বিপরীত। ঘুষ জোর করে আদায় করা হয়। এটা পার্থিব উদ্দেশ্যের জন্যই দেওয়া হয়। এটা সম্প্রীতি নয়; বরং শত্রুতা বৃদ্ধির কারণ। ইসলামিক শরিয়া আইনের দৃষ্টিতে হাদিয়া থেকে কিছু আত্মসাৎ ও হাদিয়ার নামে ঘুষ উভয় সমপর্যায়ভুক্ত। ঘুষ ইসলামে হারাম, পক্ষান্তরে হাদিয়া ইসলামে সম্মানিত হালাল। তাই দুইটাকে একসঙ্গে তালগোল পাকানোর কোনো মানেই হয় না। যদিও বর্তমানে ঘুষকে কেউ হাদিয়া বলে, কেউ উপহার, উপটৌকন, সম্মানীসহ বিভিন্ন নামে গ্রহণ করছে।

পারিশ্রমিককে হাদিয়া বলা যাবে না। পারিশ্রমিক হচ্ছে শ্রমের মূল্য আর হাদিয়া হচ্ছে খুশির সঙ্গে যা দেওয়া হয়। আবার পারিশ্রমিক এত বেশিও চাওয়া যাবে না, যা দেনেওয়ালা ব্যক্তির ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। আবার দেনেওয়ালা ব্যক্তিকেও পারিশ্রমিকের পরিমাণ খুবই সতর্কতার সঙ্গে ঠিক করতে হবে, যাতে দেওয়ার আগেই যেন শ্রমদানকারী ব্যক্তি চাইতে বাধ্য না হয়।

হাদিয়ার উপকারিতা

হাদিয়া ভালোবাসা বৃদ্ধির মাধ্যম। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

‘তোমরা পরস্পর হাদিয়া আদান-প্রদান কর, তাহলে ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে।’ (আদাবুল মুফরাদ ৫৯৪)

হাদিয়া হিংসা দূর করার উপায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

‘তোমরা পরস্পরে হাদিয়া বিনিময় কর এর দ্বারা অন্তরের সঙ্কীর্ণতা ও হিংসা দূর হয়ে যায়।’ (মুসনাদে আহমদ ৯২৫০)

হাদিয়ার বিনিময়ে হাদিয়া

হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিয়ম ছিল তিনি হাদিয়া গ্রহণ করতেন এবং এর বিনিময়ে নিজেও কিছু হাদিয়া হিসেবে দিয়ে দিতেন।’ হাদিয়ার বিনিময়ে দাতাকে কিছুই দেওয়ার না থাকলে অন্তত জাযাকাল্লাহু খায়রান (আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন) এতটুকু বললেও তার অকৃতজ্ঞতা বলে গণ্য হবে না। হাদিসে পাকে এসেছে-

হজরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যাকে হাদিয়া দেওয়া হয় যদি তার কাছে হাদিয়ার বিনিময়ে দেওয়ার মতো কিছু থাকে তাহলে দিয়ে দেবে। আর যার কাছে দেওয়ার মতো কিছুই থাকে না তখন সে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তার প্রশংসা করে দেবে এবং তার ব্যাপারে ভালো কথা বলে দেবে। যে এমন করল সে কৃতজ্ঞতা আদায় করল। আর যে এমন করল না এবং উপকারকে গোপন করল সে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল।’ (তিরমিজি)

অল্প হাদিয়াকে তুচ্ছ জ্ঞান না করা

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

‘হে মুসলিম নারীগণ! তোমাদের প্রতিবেশীর জন্য সামান্য উপহার বা হাদিয়াও তুচ্ছ মনে কর না। যদিও তা বকরির পায়ের খুর হয়।’ (বুখারি ২৪২৭)

অল্প জিনিস হলে কাউকে তা হাদিয়া দিতেও লজ্জা না করা। আবার অল্প হাদিয়া গ্রহণ করতেও নাক না ছিটকানো। কারণ এতে করে হাদিয়াদাতা মনে মনে কষ্ট পাবে। এমনটি কারলে আস্তে আস্তে হাদিয়া দেওয়া-নেওয়ার প্রচলন বন্ধ হয়ে যাবে।

হাদিয়া দিয়ে খোটা দেয়া যাবে না। হাদিয়া দিয়ে খোটা দেয়া খুবই ভয়ঙ্কর অপরাধ ও ক্ষতির কারণ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘খোটাদানকারী বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (মুসলিম)

ধনী-দরিদ্র সকলকে হাদিয়া দেওয়া

মানুষজনকে দাওয়াত করে খাওয়ানো এটিও হাদিয়ার মধ্যেই গণ্য। এ ক্ষেত্রে শুধু ধনীদেরকে দাওয়াত দেওয়া, আর দরিদ্র-অসহায়দেরকে উপেক্ষা করা নিতান্তই মন্দ একটি কাজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ওলিমায় (বিবাহের অনুষ্ঠানে) শুধু ধনীদেরকেই আমন্ত্রণ করা হয় আর দরিদ্রদেরকে বর্জন করা হয়, সে ওলিমার খাবার নিকৃষ্ট খাবার।” (বুখারি)

হাদিয়ার জন্য আকাক্ষিত না থাকা

মনে মনে আকাক্ষিষত থাকার পর যে হাদিয়া আসে এটাকে বলে ইশরাফে নফস। এটা নিষেধ। যেমন মনে মনে আশায় থাকা যে, অমুক আত্মীয় সাধারণত আমার জন্য হাদিয়া নিয়ে আসে। অমুক তারিখে উনি হজ থেকে আসছেন। আমার জন্য অবশ্যই হাদিয়া নিয়ে আসবেন। তো যে হাদিয়ায় এ ধরনের নিয়ত থাকবে সে হাদিয়া গ্রহণ করা ঠিক না। এতে বরকত থাকে না।’ (বোখারি, হাদিস : ১৪৭২)

ঋণের বিনিময়ে হাদিয়া গ্রহণ না করা

হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

‘তোমাদের কেউ যখন কাউকে ঋণ (কর্জ) দেয়, আর গ্রহীতা যদি তাকে কোনো তোহফা দেয় কিংবা যানবাহনে আরোহণ করতে বলে, তখন সে যেন তার তোহফা কবুল না করে এবং তার সওয়ারিতেও আরোহণ না করে। অবশ্য আগে থেকে যদি উভয়ের মধ্যে এরূপ লেনদেনের ধারা চলে আসে, তবে তা ভিন্ন কথা।’ (ইবনে মাজাহ)

কাফের-মুশরিকদের সঙ্গে হাদিয়া আদান-প্রদান

যদি কোনো কাফের মুশরিক কোনো মুসলমানকে হাদিয়া দেয় তাহলে সেটা গ্রহণ করা জায়েজ। তবে বস্তুটি ব্যবহার করার বৈধতা ইসলামে থাকতে হবে। নবীজি (সা.) কাফেরদের পক্ষ থেকে পাঠানো হাদিয়া গ্রহণ করেছেন। এমনিভাবে কাফেরদেরকে হাদিয়া দেয়া যাবে। তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার নিষেধ না হওয়ার কথা কুরআনেও উল্লেখ আছে। মহান আল্লাহ বলেন,

‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে স্বদেশ হতে বের করেনি তাদের প্রতি মহানুভতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। আল্লাহ তো ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালোবাসেন।’ (সূরা মুমতাহিনা, আয়াত : ৮)

হাদিয়া বৈধ হওয়ার শর্ত

১। হাদিয়া বৈধ হতে হলে অবশ্যই হালাল বস্ত হাদিয়া আদান- প্রদান করতে হবে। কোন হারাম বস্তু যেমন মদ, ঘুষ, শুকুরের মাংস, হাদিয়া আদান -প্রদান করা ইসলামে জায়েজ নেই।

২। কোন অন্যায় উদ্যেশে হাদিয়া লেন-দেন করা যাবেনা। যেমন পরীক্ষায় পাশ করে দেয়া, বিচারে রায় পাওয়া, প্রশাসনিক পদ পাওয়া, চাকরী পাওয়া, কোন বাড়তি সুবিধা দেয়া বা নেয়ার জন্য হাদিয়া দেয়া যাবেনা।

৩। হাদিয়া সম্মতিতে দিতে হবে। হাদিয়া পাওয়া যাবে এই নিয়তেও হাদিয়া দেয়া যাবেনা।

৪। বৈধ সম্পদ থেকে হাদিয়া দিতে হবে। জোর করে কেড়ে নেয়া, ছিনতাই করা কিংবা চুরি করা সম্পদ থেকে হাদিয়া দেয়া যাবেনা।

নিয়ত করে হাদিয়া দেই

যেকোন উপহার পেলে সবারই ভাল লাগে। যিনি হাদিয়া পান তিনি খুশি হন। আবার যিনি হাদিয়া দেন তিনিও খুশি হয়েই হাদিয়া দেন। ঈদ, রোজা, বিয়ে জন্মদিন, সামাজিক অনুষ্টান ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে আমরা প্রিয়জনদের, পরিচিতদের হাদিয়া দেই। কিন্ত হাদিয়া দেয়ার জন্যও নিয়ত থাকা দরকার। আমি লোক দেখানো হাদিয়া দিচ্ছি, না সেই মানুষকে খুশি করার জন্য হাদিয়া দিচ্ছি, না হক আদায়ের জন্য, না নিজের বড় লোকী দেখানোর জন্য হাদিয়া দিচ্ছি, না সেই লোকের প্রয়োজন মেটানোর জন্য হাদিয়া দিচ্ছি, সেটা পরিস্কার হওয়া দরকার। মুসলমানদের সব কাজেরই নিয়ত থাকা দরকার। নিয়ত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন,

প্রত্যেক কাজের নির্ভরতা নিয়তের উপর, যে যা নিয়ত করবে সে কেবল তাই পাবে। (বুখারী শরিফ: ১) ।

একথা থেকে বোঝা যায়। নিয়ত থাকাও জরুরী। আমরা নিয়ত ছাড়াই এমনি এমনি একে অপরকে হাদিয়া দেই। সুতরাং মনে মনে একটি নিয়ত থাকা দরকার। মহান আল্লাহর সন্তষ্টি আর রাসুল (সা:) সুন্নাত পালনের উদ্যেশে হাদিয়া দিচ্ছি। হাদিয়া দেয়ার আগে বা পরে মনে মনে এ ধরনের একটি নিয়ত করা উত্তম। এতে নিশ্চয় আরো বরকত হবে। মনে প্রাণে আরো প্রশান্তি আসবে। রাসুলের একটি সুন্নাত আদায় হবে। আর আমাদের জীবনে একটি সুন্নাত পালনের ছোওয়াব লেখা হবে। এটিও হবে একটি নেক আমল।

হাদিয়াদাতাকেও হাদিয়া দেওয়া
ইসলাম আমাদের সৌহাদ্য আর ভ্রাতৃত্ব বোধ শেখায়। প্রতিদান দিতে শেখায়। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

কোনো পুণ্যের কাজকেই তুচ্ছ জ্ঞান করো না; এমনকি হাসিমুখে কোনো ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকেও না। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ৬৮৫৭)।

আল্লাহর নামে কেউ আশ্রয় চাইলে তাকে আশ্রয় দাও। আল্লাহর নামে কেউ যাঞ্চা করলে তাকে দাও। কেউ অনুগ্রহ করলে প্রতিদান দাও। প্রতিদান দিতে না পারলে অন্তত তার জন্যে দোয়া করো। (সুনানে কুবরা লিন নাসায়ী, হাদীস নং- ২৩৪৮)।

আল্লাহ পাক আমাদেরকে হাদিয়া আদান-প্রদানের সুন্নতটির ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

সংগৃহীত

Views: 164